একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ৷ সুপ্রিয় পাঠক! আশা করছি ভাল এবং সুস্থ আছেন ৷ আজ বহুল আলোচিত এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আপনাদের সাথে আলোচনা করব ৷ আর্টিকেলটি পুরো না পড়ে কেউ মন্তব্য করবেন না ৷ শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকুন ৷ আশা করছি তিন তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সুন্দর সমাধান পাবেন ইনশাআল্লাহ ৷ আজকের লেখা একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ ৷ তিন তালাকের ফতোয়া ৷ রাগ করে তিন তালাক দিলে কি তিন তালাক গণ্য হবে? একসাথে তিন তালাকের বিধান ৷ তিন তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার বিধান ৷ মোবাইলে তালাক দিলে কি তালাক হবে? স্বাক্ষী ছাড়া তালাক ইত্যাদি ৷

আরও পড়ুনঃ ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব ও নিয়ম

তালাক সম্পর্কে জানতে হ’লে কয়েকটি পরিভাষা জানা আবশ্যক। যথা- ইদ্দত, মাসিক বা ঋতু, পবিত্রকাল, রাজঈ তালাক, বায়েন তালাক, মুগাল্লাযা তালাক ইত্যাদি।

ইদ্দত মানে কি? ইদ্দত কেনো পালন করতে হয়? 

ইদ্দত বলা হয় তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী ঋতুবতী হলে, তালাকপ্রাপ্তির পর থেকে তিন ঋতু পর্যন্ত ৷ আর ঋতুবতী না হলে তিন মাস বা ৯০ দিন পর্যন্ত শারঈ নিয়মে যে বিশেষ অবস্থায় কালাতিপাত করে তাকে ইদ্দত বলে। ইদ্দত চলাকালে অন্য পুরুষকে বিয়ে করা যায় না। কোন কোন তালাকে ইদ্দতকালে বিয়ে বহাল থাকে এবং স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ইদ্দতকালে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার ওয়ারিছও হবে।

মাসিক কি? মাসিক কত দিন হয়? 

প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের সাধারণতঃ প্রতি মাসে একবার গর্ভাশয় থেকে রক্তস্রাব হয়। একে মাসিক বা ঋতু বলে। মাসিকের আরবী প্রতিশব্দ ‘হায়েয’ (الحيض)। সাধারণতঃ তিন থেকে দশ দিন এই রক্ত নির্গত হয়। মাসিকের সময় তালাক দেওয়া শরী‘আতে নিষিদ্ধ।

নারীর পবিত্রকাল

দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়কালকে পবিত্রকাল বলে। পবিত্রকালের আরবী প্রতিশব্দ ‘তুহুর’ (الطهر)। তালাক এই পবিত্রকালে সহবাসমুক্ত অবস্থায় দিতে হয়। অবশ্য যাদের মাসিক শুরু হয়নি কিংবা বয়সজনিত কারণে বন্ধ হয়ে গেছে তারা সব সময় পবিত্রকালের মধ্যে গণ্য। তাদের তালাকদানে সহবাস থেকে মুক্ত হওয়ার কথা নেই।

রাজঈ তালাক

যাদের মাসিক হয় এমন নারীদের পবিত্রকালে সহবাসমুক্ত অবস্থায় এবং যাদের মাসিক হয় না তাদের যেকোন অবস্থায় এক তালাক দিলে ইদ্দতকাল পর্যন্ত উক্ত তালাককে রাজঈ তালাক বলে। রাজঈ অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাহার করা। এরূপ তালাকে ইদ্দতের মধ্যে তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে ফিরে আসা যায়। তাই একে রাজঈ তালাক বলে। বৈবাহিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের পর স্বামী দুই তালাকের মালিক থাকবে। এর মধ্যে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে।

বায়েন তালাক

রাজঈ তালাক দেয়ার পর ইদ্দতের মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নিলে উক্ত রাজঈ তালাক ইদ্দত শেষ হওয়ার সাথে সাথে বায়েন তালাকে পরিণত হবে। বায়েন অর্থ বিচ্ছিন্নকারী। অর্থাৎ তালাক বায়েন হওয়ার সাথে সাথে বিবাহ পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যাবে। এবার স্ত্রী চাইলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে, আবার চাইলে তালাকদাতা স্বামীকেও নতুনভাবে বিয়ে করতে পারবে। বায়েন তালাকও দু’বার পর্যন্ত সিদ্ধ। অবশ্য বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর সাথে সহবাস কিংবা নির্জনবাসের পূর্বেই তালাক দিলে তৎক্ষণাৎ তা এক তালাক বায়েন বলে গণ্য হবে।

মুগাল্লাযা তালাক

দুই তালাক রাজঈ কিংবা দুই তালাক বায়েনের পর স্বামীর হাতে থাকা এক তালাকও দিয়ে দেয়া হলে তাকে মুগাল্লাযা তালাক বলে। মুগাল্লাযা অর্থ চূড়ান্ত। এই তালাকের পর ইদ্দতের মধ্যে কিংবা শেষে স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। এবার স্ত্রী স্বাধীনভাবে অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে। তারপর উক্ত স্বামীও যথা নিয়মে তালাক দিলে কিংবা মারা গেলে প্রথম স্বামীকে চাইলে সে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। অতএব তালাক প্রথমে রাজঈ তারপর বায়েন এবং সর্বশেষে মুগাল্লাযায় পরিণত হয়।

ইসলামী শরীয়তে তালাক আল্লাহ তা’আলার নিকট অতি অপছন্দনীয় কাজ। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ হলো তালাক।(আবু দাউদ,হাদিস ২১৭৮)

একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

 

কিন্তু এরপর যদি আবার কখনো শুধু এক তালাকই দেওয়া হয় এবং সব মিলে তিন তালাক হয়ে যায় এ অবস্থায় আর তাকে ফিরিয়ে আনারও সুযোগ থাকবে না, নতুন করে বিয়ে করার বৈধতাও বাকি থাকবে না।

একসাথে তিন তালাক দিলে কত তালাক হবে?

কোনো ব্যক্তি যদি শরীয়তের সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে একই সাথে তিন তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তিন তালাকই কার্যকর হয়ে যায়।

এক মজলিসে তিন তালাক দিলে?

সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে থেকে আজ পর্যন্ত উম্মাহ’র ইজমা হলো, এক মাজলিসে তিন তালাক এক বাক্যে হোক বা পৃথক পৃথক বাক্যে দেওয়া হোক, অথবা বিভিন্ন সময়ে তিন তালাক দেওয়া হোক, সর্বাবস্থায় তিন তালাকই স্ত্রীর উপর পতিত হয়ে যাবে এবং অন্যত্র বিবাহের পর দ্বিতীয় স্বামীর সাথে মেলামেশা না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামীর জন্য উক্ত স্ত্রী হালাল হবে না।

একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ
একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

 

আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-

الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ ۖ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ ۗ وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَن يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا ۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ [٢:٢٢٩]

তালাকে-‘রাজঈ’ হ’ল দুবার পর্যন্ত তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে। আর নিজের দেয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদের কাছ থেকে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবে উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই জালেম। {সূরা বাকারা-২২৯}

এইতো গেল দুই তালাকের বিধান। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তিন তালাক প্রদানের বিধান ঘোষণা করে ইরশাদ করেন-

فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ [٢:٢٣٠]

তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়। {সূরা বাকারা-২৩০}

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতের দ্বারা পরিস্কার প্রমাণিত হয় যে,

তিন তালাক প্রদান করলে তিন তালাকই পতিত হবে। এক তালাক নয়।

এক বাক্যে তিন তালাক পতিত হওয়ার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়সালা সহীহ বুখারী শরীফ (২/৭৯১) এবং সুনানে আবি দাউদ, বাবুল- লিআন (১/৩২৪) এ-উল্লেখ আছে:

হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলো। অতঃপর ঐ মহিলা অন্যজনকে বিবাহ করলে সেও তাকে তালাক দিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হলো, সেকি প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘না। যতোক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী প্রথমজনের মতো ঐ মহিলার মধু আস্বাদন না করবে’, অর্থাৎ যতোক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী তার সাথে সহবাস না করবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত সে প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে না। (সহীহ বুখারী: ৫২৬১)

“عن ابن شهاب عن سهل بن سعد في هذا الخبر قال: فطلقا ثلاث تطليقات عند رسول الله صلي الله عليه وسلم، فأنفذه رسول الله صلي الله عليه وسلم”.( ابو داؤد).

সাহল ইবনু সা’দ আস-সাইদী রা. সূত্র থেকে বর্ণিত,উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে বর্ণিত। তিনি বলেন, অতঃপর ‘উয়াইমির তার স্ত্রীকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপস্থিতিতে তিন তালাক প্রদান করলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা কার্যকর করলেন। (আবু দাউদ,হাদিস নং২২৫০ হাদিসের মান: সহীহ)

একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ
একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

হযরত হাসান বিন আলী রা. তার স্ত্রী আয়িশা বিনতে ফযলকে একসাথে তিন তালাক দিলেন। অতঃপর তার স্ত্রীর আবেগময় কথা শুনে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, যদি আমি নানাকে (অন্য বর্ণনায় তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন) একথা বলতে না শুনতাম, “কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, তবে ঐ স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ না বসা পর্যন্ত তার জন্য হালাল হবে না”- তাহলে অবশ্যই তাকে ফেরত নিতাম । (সুনানে বাইহাকী হাদিস নং ১৪৯৭১)

ই’লাউস সুনানে এসেছে, একব্যক্তি তার স্ত্রীকে একশত তালাক দিলে হযরত ইবনে আব্বাস রা. তাকে বললেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের নাফরমানী করেছো, তোমার স্ত্রী তোমার থেকে বায়েনা হয়ে গেছে। তুমি তো আল্লাহকে ভয় করোনি যে, আল্লাহ তোমার জন্য কোনো পথ বের করে দিবেন। অতঃপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ বের করে দেন”। (ই’লাউস সুনান: ৭/৭০৮, আস সুনানুল কুবরা, বাইহাকী: ৭/৫৪২, হা.নং ১৪৯৪৪)

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর ফয়সালা “মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ”-এ উল্লেখ আছে,

“عن أنس رضي الله عنه: كان عمر رضي الله عنه إذا أتي برجل قد طلق إمرأته ثلاثاً في مجلس أوجعه ضرباً و فرق بينهما”. (باب من كره أن يطلق الرجل إمرأته ثلاثاً ٤/١١).

হযরত আনাস রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,ওমর রা.এর নিকট যখন এমন কোনো ব্যক্তিকে আনা হতো, যে তার স্ত্রীকে এক সমাবেশে তিনবার তালাক দিয়েছে,তিনি তাকে মারধর করতেন এবং তাদের আলাদা করে দিতেন।(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ ৪/১১)

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর ফয়সালা
“মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ”-এ উল্লেখ আছে,

“عن معاوية ابن أبي يحي قال: جاء رجل إلى عثمان فقال: إني طلقت امرأتي مائةً؛ قال: ثلاث تحرمها عليك و سبعة و تسعون عدوان”. ( باب ماجاء يطلق إمرأته مائة و ألف في قول واحد ٤/١٣).

মুয়াবিয়া ইবনে আবি ইয়াহইয়ার সূত্রে বর্ণিত,তিনি বলেন: এক ব্যক্তি ওসমানের কাছে এসে বলল: আমি আমার স্ত্রীকে একশত তালাক দিয়েছি। তিনি বললেনঃ “তিনটি তালাকই স্ত্রীকে হারাম করে দিয়েছে এবং সাতানব্বইটি দ্বারা সীমালঙ্ঘন হয়েছে।” (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ ৪/১৩)

চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর ফয়সালা
“মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাকে” উল্লেখ আছে,

“عن شريك بن أبي نمر قال: جاء رجل إلى علي رضي الله عنه فقال: إني طلقت إمرأتي عدد العرفج؛ قال: تأخذ من العرفج ثلاثاً و تدع سائره”. (باب الطلق ثلاثاً ٦/٣٠٦).

শারীক বিন আবি নামির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি আলী রা.এর কাছে এসে বললো: আমি আমার স্ত্রীকে আরফাজ গাছের সংখ্যা অনুযায়ী তালাক দিয়েছি। তিনি বললেন,তুমি আরফাজের তিনটি নিয়ে নাও এবং বাকিগুলো অকার্যকর হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাকে ৬/৩০৬)

ইমাম কুরতুবি রহি.এর তাফসীরে “আহকামুল কুরআনে”- তিন তালাকের ব্যাপারে উম্মাহর ঐকমত্য
উদ্ধৃত হয়েছে,

“قال علمائنا: و اتفق ائمة الفتوى علي لزوم إيقاع الطلاق الثلاث في كلمة واحدة”. (١/٦٩٢)

“আমাদের আলেমগণ বলেছেন: ফতোয়া প্রদানকারী ইমামগণ ঐক্যমতপোষণ করেছেন এক বাক্যে তিন তালাক পতিত হওয়ার আবশ্যকীয়তার ব্যাপারে।”(692/1)

মুসলিম শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ “আল-জামিউস সহীহ” লিন-নাওয়াভী তে রয়েছে,

“وقد اختلف العلماء فيمن قال لإمرأته: “أنت طالق ثلاثاً” فقال الشافعي و مالك و أبو حنيفة و أحمد و جماهير العلماء من السلف و الخلف: يقع الثلاث”. (١/٤٧٨ ط: قديمي)

উলামায়ে কেরাম মতভেদ করেন ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে যে তার স্ত্রীকে বলে “তুমি তিন তালাকপ্রাপ্ত।” অতঃপর ইমাম শাফিঈ, মালিক, আবু হানিফা, আহমদ এবং পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিদের থেকে জমহুর উলামায়ে কেরাম বলেন,তিন তালাকই কার্যকর হবে।” (1/478)

হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত প্রসিদ্ধ ফাতাওয়া গ্রন্থ
“ফাতাওয়ায়ে শামীতে” রয়েছে

“(قوله: ثلاثة متفرقة) و كذا بكلمة واحدة بالأولى … و ذهب جمهور الصحابة و التابعين و من بعدهم من أئمة المسلمين الي أنه يقع الثلاث”. ( كتاب الطلاق : مطلب طلاق الدور ٣/٣٣٣ ط:سعيد).

“(তাঁর উক্তি: তিনটি পৃথক তালাক) এমনিভাবে এক বাক্যে তিন তালাক,সবই কার্যকর হবে……
জমহুর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িনগণ এবং তাদের পরে মুসলিম ইমামগণ সকলেরই মত যে,তাতে তিন তালাকই কার্যকর হবে।” ফাতাওয়ায়ে শামী 3/333

মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধগ্রন্থ “আত-তামহিদ” লি-ইবনে আব্দিল বার-এ রয়েছে

“فإن طلقها في كل طهر تطليقةً أو طلقها ثلاثاً مجتعات في طهر لم يمس فيه فقد لزمه”. (٦/٥٨)

“সুতরাং যদি সে তার স্ত্রীকে প্রত্যেক পবিত্রতার মধ্যে এক তালাক দেয় অথবা তিন তালাক এক সাথে দেয় এমন এক পবিত্রতার সময়,যাতে সহবাস করা হয়নি,
তাহলে তা আবশ্যক হয়ে যাবে। আত-তামহিদ ৬/৫৮

ইমাম শাফিঈ রহ.এর প্রসিদ্ধগ্রন্থ “কিতাবুল উম”এ রয়েছে,
“و القراٰن يدل-و الله اعلم- على أن من طلق زوجةً له دخل بها أو لم يدخل بها ثلاثاً لم تحل له حتى تنكح زوج غيره”. (٢/ ١٩٣٩)

“এবং কোরআন ইঙ্গিত করে-এবং আল্লাহই ভাল জানেন – যে,যদি কেউ তার এমন স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, যার সাথে সে সহবাস করেছে বা করেনি,তাহলে সে তার জন্য বৈধ নয় যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীকে বিয়ে করে।” (2/1939)

হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব “মাসায়েলে আহমাদ”
এ-রয়েছে
” قلت لأبي: رجل طلق ثلاثاً وهو ينوي واحدةً؟ قال: هي ثلاث”. (ص:٣٧٣)

“আমি আমার পিতাকে বললাম: এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে এমতাবস্থায় যে সে নিয়ত করে এক তালাকের? তখন তিনি বললেন তিন তালাকই কার্যকর হবে।” (মাসায়েলে আহমাদ 373)

 

রাগ করে তিন তালাক দিলে কি তিন তালাক গণ্য হবে

আসলে তালাক তো দেওয়াই হয় রাগের মাথায়। কয়জন আছে, শান্তভাবে তালাক দেয়! মূলতঃ রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়, এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

ثَلاثٌ جِدُّهُنَّ جِدٌّ وَهَزْلُهُنَّ جِدٌّ : النِّكَاحُ ، وَالطَّلاقُ ، وَالرَّجْعَةُ

তিনটি বিষয় এমন রয়েছে যা গোস্বায় হোক বা হাসি ঠাট্টায় হোক সর্বাবস্থায় কার্যকরী হয়ে থাকে। বিবাহ, তালাক ও রজয়াত। (আবু দাউদ ২১৯৪ তিরমিযি ১১৮৪)

মেসেজের মাধ্যমে তালাক দিলে কি কার্যকর হবে?

মুখে তালাক দিলে যেভাবে তালাক হয় তেমনি মেসেজের মাধ্যমে তালাক পাঠালেও তালাক পতিত হয়। আর তালাক কখন কার্যকর হবে? স্ত্রীর কাছে মেসেজ পৌঁছার পর নাকি মেসেজ লেখার পর থেকেই- এটা নির্ভর করবে মেসেজ লেখার ধরনের ওপর। যদি মেসেজে এভাবে লেখা হয় যে, ‘যখন আমার এই বার্তা তোমার কাছে পৌঁছবে তখন থেকে তুমি তালাক’ তাহলে স্ত্রীর কাছে মেসেজ পৌঁছার পরই তালাক হবে- স্ত্রী মেসেজটি পাঠ করুক বা না করুক।
সুতরাং স্ত্রীর কাছে মেসেজ পৌঁছার আগেই যদি স্বামী তা ডিলেট করে দেয় তাহলে আর তালাক হবে না। আর যদি লেখে- ‘তুমি তালাক’ তাহলে লেখার পর থেকেই তালাক হয়ে যাবে- মেসেজ স্ত্রীর কাছে পৌঁছুক বা না পৌঁছুক।

সূত্র: সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২০৩৯, ফাতাওয়া শামী-৪/৪৫৬ (জাকারিয়া) বাদায়েউস সানায়ে-৩/১০৯. ফাতাওয়া হিন্দিয়া-১/৩৭৮, ফিকহুস সুন্নাহ ৩/১৬৫. কাওয়াইদুল ফিকহ-১৩০ (দারুল কিতাব) ফাতাওয়া তাতারখানিয়া-৪/৫২৮ (জাকারিয়া), আল মহিতুল বুরহানী-৪/৪৮৬

মোবাইলে তালাক দিলে কি তালাক হবে?

স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তালাক উচ্চারণ করার দ্বারাই স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হয়ে যায়।এজন্য তালাক শব্দটি স্ত্রীর নিজে শোনা যেমন জরুরী নয়, তেমনি সংবাদ স্ত্রীর কাছে পৌছানোও জরুরী নয়। এমনিতেই তালাক পতিত হয়ে যায়। বাকি স্ত্রীকে জানিয়ে দেয়া জরুরী যেন স্ত্রী ইদ্দত পালন করে স্বাধীন হয়ে যেতে পারে।

সে হিসেবে মুঠোফোনে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়। কারণ স্ত্রী উদ্দেশ্য করে মুখে তালাক বললেই যেখানে তালাক হয়ে যায়, সেখানে মুঠোফোনে বলার দ্বারা তালাক পতিত হতে কোন প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি হচ্ছে না। তালাকতো স্বামীর মুখে বলার দ্বারাই হয়ে যাচ্ছে। সেটি মুঠোফোনের মাধ্যমে পৌছুক বা না পৌছুক এর সাথে তালাক পতিত হওয়া ও পতিত না হবার কোন সম্পর্কই নেই। তাই আলাদাভাবে মুঠোফোনের দ্বারা তালাক পতিত হবার কোন তফাৎ নেই। আশা করি বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে।

স্বাক্ষী ছাড়া তালাক দিলে হুকুম কি? 

তালাক স্ত্রীকে শুনিয়ে দিতে হবে কিংবা সাক্ষী রাখতে হবে; তালাকের ক্ষেত্রে এজাতীয় কোনো শর্ত নেই। বরং ফকিহগণের ঐকমত্য হল, স্বামী যদি নির্জনে একা একা বসে তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যায়। (রদ্দুল মুহতার ৪/৯৬, দারু আলামিল কুতুব, রিয়াদ, আল্মুহীতুল বুরহানী ৩/২১০)

একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ
একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

শেষ কথা

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

One thought on “একসঙ্গে তিন তালাক : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *