সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে | মাওলানা দীদার মাহদী

সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে | মাওলানা দীদার মাহদী

আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ ৷ সুপ্রিয় পাঠক! আশা করছি সবাই ভালো এবং সুস্থ আছেন ৷ আজ আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস নিয়ে আলোকপাত করবো ৷ আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিসের দারস পেশ করব ইনশাআল্লাহ ৷ আশা করছি আজকের লেখা থেকে উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ ৷

আরও পড়ুনঃ হারিসুল আশআরী বর্ণিত সংগঠন সংক্রান্ত হাদীস

সাত ব্যক্তিকে আরশের নিচে ছায়া দান

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ الإِمَامُ الْعَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ‏.‏ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ ‏”‏‏.

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত :

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে দিন আল্লাহ্‌র (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন।

  • ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক,
  • ২. সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে,
  • ৩. সে ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে,
  • ৪. সে দু’ ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে, একত্র হয় আল্লাহ্‌র জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহ্‌র জন্য,
  • ৫. সে ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহবান জানায়, কিন্তু সে এ বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’,
  • ৬. সে ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না,
  • ৭. সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিক্‌র করে, ফলে তার দু’ চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে।

[বুখারি ৬৬০, ১৪২৩, ৬৪৭৯, ৬৮০৬, মুসলিম ১০৩১, তিরমিযি ২৩৯১, নাসায়ি ৫৩৮০, আহমদ ৯৩৭৩, মুওয়াত্তা মালিক ১৭৭৭]

রাবী’র পরিচয়ঃ

নাম: তার নাম সম্পর্কে ৩৫টি অভিমত পাওয়া যায়। বিশুদ্ধতম অভিমত হলো ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নাম ছিল।
১. আবদুস শাসছ
২. আবদু আমর
৩. আবদুল ওযযা
ইসলাম গ্রহণ করার পর –
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে সাখর।
৫. আবদুর রহমান ইবনে সাখর
৬. ওমায়েক ইবনে আমের

উপনাম: আবু হুরায়রা।
পিতার নাম: সাখর
পিতার নাম: উম্মিয়া বিনতে সাফীহ। অথবা মাইমুনা।

আবু হুরায়রা নামে প্রসিদ্ধির কারণ

আবু হুরায়রা শব্দের অর্থ বিড়াল ছানার পিতা। (আবু=পিতা; হুরায়রা=বিড়াল ছানা) একদা তিনি তার জামার আস্তিনের নিচে একটা বিড়াল ছানা নিয়ে রাসূল (সা:) এর দরবারে হাজির হন। হঠাৎ বিড়ালটি সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ে। তখন রাসূল (সা:) রসিকতা করে বলে উঠলেন- “হে বিড়ালের পিতা” তখন থেকে তিনি নিজের জন্য এ নামটি পছন্দ করে নেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

ইসলাম গ্রহণঃ তিন ৭ম হিজরী মোতবেক ৬২৯ খৃস্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল বিন আমর আদ-দাওসীর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন।
হাদীস বর্ণনাঃ সর্বপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনাকারী। বর্ণিত হাদীস ৫৩৭৪ টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৪১৮টি।
মৃত্যুঃ ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে কাসবা নামক স্থানে।

গ্রন্থ পরিচিতিঃ
গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মুসলিম যার পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন-নিশাপুরী। খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুওে ২০৪ হিজরী ২৪ শে রজব জন্মগ্রহণ করেন। ১৫ বছর সহ হাদীস সংখ্যা ১২,০০০। ছাড়া ৪,০০০ মাত্র। এ মনীষী ২১৬ হিজরী সনে ৫৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

ব্যাখ্যাঃ এখানে কিয়ামতের এক ভীষণ চিত্রের কথা তুলে মানুষের মনে প্রথমে ভীতি জাগানো হয়েছে। এরপর সেই ভীতি বা শাস্তি থেকে যে শ্রেণীর লোক রক্ষা পাবে তার বর্ণনা দিয়ে মূলত মানুষকে সেইসব গুনে গুনান্বিত হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছে।

যে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়ায় স্থান পাবে

রসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামকে নসীহত করতেন। একদিন নসীহত করতে গিয়ে তিনি সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন যে, কেয়ামতের ভয়াবহ দিনে আল্লাহ পাক সাত ধরনের মানুষকে আরশের নীচে ছায়া দিবেন। যেদিন আর কোন ছায়া থাকবে না, সূর্য মাথার কাছে চলে আসবে। প্রচণ্ড গরম হবে। সূর্য মাথার কাছে চলে আসলে কেমন গরম হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে এখন সূর্য আমাদের থেকে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থান করছে। সেই গরমে আমরা অতিষ্ট হয়ে যাই। আর কেয়ামতের দিন এই সূর্য মাথার কাছে এসে যাবে। মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না যে, তখন কী অবস্থা হবে। এছাড়াও কেয়ামতের দিনের যে ভয়াবহতা হবে তাও কল্পনা করা যায় না। সূরা হজ্জের শুরুতে আল্লাহ পাক কেয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা বর্ণনা তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمۡ ۚ اِنَّ زَلۡزَلَۃَ السَّاعَۃِ شَیۡءٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱﴾ یَوۡمَ تَرَوۡنَہَا تَذۡہَلُ کُلُّ مُرۡضِعَۃٍ عَمَّاۤ اَرۡضَعَتۡ وَ تَضَعُ کُلُّ ذَاتِ حَمۡلٍ حَمۡلَہَا وَ تَرَی النَّاسَ سُکٰرٰی وَ مَا ہُمۡ بِسُکٰرٰی وَ لٰکِنَّ عَذَابَ اللّٰہِ شَدِیۡدٌ ﴿۲﴾

হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা দেখবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্য দানকারিনী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতাল সদৃশ, অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর আযাবই কঠিন। [সূরা হাজ্জ: ১-২]

সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে

এখানে কেয়ামতের ময়দানের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি মোসাল্লাম বলেছেন, ঐ ভয়াবহ দিনে সাত ধরনের মানুষ এমন থাকবে, যাদেরকে আল্লাহ পাক তাঁর আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। কেয়ামতের দিন এটা হবে আল্লাহর বিশেষ রহমত। আল্লাহ পাক তাদের প্রতি খাস রহমত দান করবেন। যারা সেদিন আরশের নীচে ছায়া পেল তারা আল্লাহ পাকের খাস রহমত প্রাপ্ত হল। এই সাত প্রকারের লোকের মধ্যে প্রথম প্রকারের লোক হল-

الإمام العادل.

১. ন্যায়পরায়ন বা ইনসাফগার নেতা

মূলত এখানে নেতা বলতে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বোঝানে হয়েছে। তা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা কোন দলের নেতা যাই হোক না কেন। নেতৃত্বের ব্যাপারে ন্যায় ও ইনসাফ।

হাদীসে এসেছে“সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী-মুসলিম)

ইনসাফ ভিত্তিক নেতৃত্ব না হলে তা অধিনস্তদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের প্রতি অনীহা সৃষ্টির ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিশৃংখলা দেখা দেয়।
রাসূল (সা:) বলেন “যে ব্যক্তি মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেবেন।” (বুখারী-মুসলিম)

যাদের হাতে যতটুকু শাসন ক্ষমতা আছে, সে যদি সেই ক্ষমতার অপব্যবহার না করে, বরং ইনসাফের সাথে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তাহলে আল্লাহ পাক তাকে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। আল্লাহ পাক হলেন ইনসাফগার, তাঁর আরশ বা সিংহাসন হল ইনসাফের প্রতীক, ভাই ইনসাফগারদেরকে তিনি সেই ইনসাফের প্রতীক আরশের নীচে স্থান দান করবেন।

ক্ষমতা হাতে আসলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। ক্ষমতা হাতে আসলে মানুষ বেসামাল হয়ে যায়। তখন দুই দিক থেকে জুলুম হয়,

  • (১) নিজের পক্ষে যতটুকু প্রাপ্য তার চেয়ে বেশী নেয়, এটাও বেইনসাফী এটাও জুলুম।
  • (২) প্রতিপক্ষের যতটুকু প্রাপ্য তার চেয়ে তাদেরকে কম দেয় বরং তাদেরকে কতভাবে দমন করা যায়, কতভাবে নিষ্পেষিত করা যায় সেই চেষ্টা করে।

এখানে প্রতিপক্ষের যতটুকু প্রাপ্য তাও দেয়া হল না বরং উল্টো জুলুম করা হল। এভাবে মানুষ ক্ষমতা পেলে ব্যালেন্স হারা হয়ে পড়ে, জুলুম করতে থাকে। একমাত্র যে আল্লাহর কথা স্মরণ রাখে যে, আমার চেয়ে আমার আল্লাহ জাল্লা শানুহুর ক্ষমতা বেশী, আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করলে আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাকে পাকড়াও করবেন, একথা যে স্মরণ রাখে সে-ই ক্ষমতা পাওয়া সত্ত্বেও জুলুম থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে।

আল্লাহর ক্ষমতার সামনে দুনিয়ার ক্ষমতা মশা-মাছির সমতুল্যও না। আল্লাহ পাক তো একটা মশা দিয়ে নমরূদের মত প্রতাপশালী সম্রাটকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আমি সামান্য ক্ষমতা পেয়ে যদি এতটা বেসামাল হয়ে যাই, নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারি, মানুষের উপরে জুলুম করতে থাকি ৷ তাহলে আল্লাহ পাকের কাছে আমি অপরাধী সাব্যস্ত হব ৷ তাহলে আল্লাহ পাকের যে ক্ষমতা তিনি আমাকে অনেক কিছু করতে পারেন। এসব কথা স্মরণ রাখলে ক্ষমতার অপব্যবহার করার মত মনোভাব জাগ্রত হয় না।

ক্ষমতা পেয়েও যারা ক্ষমতার অপব্যবহার না করে, তার অর্থ হল সে সদা সর্বদা এসব চিন্তা মনের মধ্যে জাগ্রত রাখে ৷ সে সদা সর্বদা আল্লাহর ভয়ে কম্পিত থাকে ৷ সে তো আল্লাহর আপন মানুষ । তাই আল্লাহ পাক আপন হিসেবে তাকে চিহ্নিত করবেন এবং তাঁর আরশের নীচে তাকে ছায়া দান করবেন। আর যার ক্ষমতা নেই, শক্তি নেই, সে জুলুম থেকে বিরত থাকলে তার মধ্যে এমন কোন আল্লাহর আপন হওয়ার মত কৃতিত্ব ফুটে ওঠে না। ফারসিতে প্রবাদ আছে-

گدا گر تواضع کند خوئے اوستے۔
এই প্রবাদের ভাবার্থ হল- যার টাকা পয়সা আছে, ধন-সম্পদ আছে সে যদি তাওয়াজ্জু বা বিনয়ের অধিকারী হয়, তাহলে তার বিনয়ের মূল্য আছে। আর যে ফকীর, সে যদি বিনয় দেখায় তাহলে তার সেই বিনয়ের কোন মূল্য নেই।

কারণ তার মধ্যে বিনয় ছাড়া অহংকার দেখানোর মত আছেই বা কি? তাই যার ক্ষমতা আছে সে যদি আল্লাহকে স্মরণ রেখে জুলুম থেকে বিরত থাকে, তাহলে সেটার মূল্য অনেক। তাই ক্ষমতার অপব্যবহার না করলে আল্লাহ পাক এর উসিলায় তাকে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন ।

আল কোরআনের বিচারে ন্যায়পরায়ন নেতার বা রাষ্ট্র প্রধানের ৪ দফা কাজ-
১. নামাজ কায়েম করা
২. যাকাত আদায় করা
৩. সৎ কাজের আদেশ করা
৪. অসৎ কাজে নিষেধ/বাধা দেয়া

অর্থ: “তারা এমন লোক যাদেরকে আমি যমিনে ক্ষমতা দান করলে নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দেবে। আর সব বিষয়ের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে।” (সুরা হজ্জ-৪১)

অর্থঃ “আমি তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছিলাম তারা আমার বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে পথ প্রদর্শন করে। আমি ওহীর মাধ্যমে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করা আদেশ করেছি, তারা খাটিভাবে আমার ইবাদত করত।” (সুরা আম্বিয়া-৭৩)

দ্বিতীয় প্রকারের লোক হল-

২. যৌবনে যারা ইবাদতে কাটিয়েছে

وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ

যারা যৌবনে আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৎপর হয়। আমরা তো বয়স হলে খুব আল্লাহকে স্মরণ করি ৷ যৌবন বয়সে আল্লাহকে তেমন স্মরণ করি না। যৌবনের সময় মনে করি, এই বয়সটা তো ফূর্তিফার্তির বয়স ৷ এখন কি ইবাদতের বয়স হয়েছে? অনেক গার্জিয়ানও এমন আছে, যারা তাদের ছেলে-মেয়েরা অল্প বয়সে ইবাদত-বন্দেগী শুরু করলে মনে করেন বা মুখে বলেও থাকেন যে, এখন কি এসবের বয়স হয়েছে? এখন তো লেখাপড়া করার বয়স। তাদের ভাবখানা এমন যে, ইবাদত-বন্দেগী করার বয়স হল যখন বৃদ্ধ হবে ৷ যখন কোমর বাঁকা হয়ে আসবে ৷ যখন দুনিয়ার কোন কিছু করার দৈহিক ক্ষমতা আর থাকবে না তখন ।

তারা উল্টো বুঝে বসে আছে ৷ তারা যৌবনে ইবাদতকে পছন্দ করে না ৷ অথচ আল্লাহ, আল্লাহর রসূল যৌবন বয়সে ইবাদতকেই বেশী পছন্দ করেন। বুড়া হয়ে গেলে কোমর যখন বাঁকা হয়ে যায়, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর, সোজা হয়ে বসার, সঠিক ভাবে রুকু করার যখন কোন ক্ষমতা থাকেনা, তখন ইবাদত করার কী মূল্য? তখনো ইবাদত করতে হবে ৷ তবে যারা যৌবনের উচ্ছলতাকে উপেক্ষা করে ইবাদত করছে ৷ যৌবনের পাপের চাহিদাকে উপেক্ষা করে ইবাদত করছে ৷ তাদের ইবাদত আর যাদের এক পা কবরে চলে গেছে তাদের ইবাদত কখনই সমান হতে পারে না।

যৌবনে ইবাদতের মূল্য অনেক বেশী । অপর হাদীসে পাচটি বিষয়ের পূর্বে পাচটি বিষয় গুরুত্ব দেয়ার কথা এসেছে ৷ এরমধ্যে যৌবন কাল গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ তাদের ইবাদত করতে নফসের সাথে মুজাহাদা বেশী করতে হয়। তাই যারা যৌবনে ইবাদতের জন্য তৎপর হয়, তারা আল্লাহ পাকের বিশেষ পছন্দের মানুষ হয়ে যায়। তাই বিশেষ পছন্দের মানুষ হিসেবে আল্লাহ পাক তাদেরকে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। এই হল দ্বিতীয় প্রকারের লোক, যাদেরকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। তৃতীয় প্রকারের লোক হল

৩. এমন মুসল্লী যার অন্তরকরণ মসজিদের সাথে ঝুলন্ত

وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ

অন্তকরণ মসজিদের সাথে ঝুলানো থাকে এর অর্থ আল্লাহর সাথে সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারে তার ব্যাকুলতা। দৈনিক পাচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে পড়ার জন্য ব্যাকুলতা। যে ব্যক্তি নামায পড়ার পর মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় কিন্তু আবার নামাযের জন্য মসজিদে আসার কথা তার মনের মধ্যে জাগ্রত থাকে। এ লোকের অবস্থা এমন যে, মসজিদ থেকে যেন বের হতে তার মনে চায় না কিন্তু প্রয়োজনের তাগীদে তাকে বের হতে হয়েছে। সংসার ধর্ম করা, সমাজ-সমাজিকতার কাজ করা, আয়-উপার্জনের কাজ করা এগুলো তার করতে হয়, এই প্রয়োজনে সে বের হয়েছে ৷ কিন্তু আসলে তার মন লাগানো রয়েছে মসজিদের সাথে।

আবার যখন সে মসজিদে ফিরে আসে, তখন সে এতমিনান বা প্রশাস্তি বোধ করে। আবার প্রয়োজনে বের হয় কিন্তু বের হতে তার মনে চায় না। আবার ফিরে আসলে তার এতমিনান হয়। অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারের সাথে তার মহব্বতের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাহলে এরূপ লোকও আল্লাহর খাস লোক, তারা খাঁটি মু’মিন । তাই আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর আরশের নীচে তাদেরকে ছায়া দান করবেন।

আর যদি এর উল্টো হয় যে, মসজিদে এসেছি কোন রকম নামায শেষ হতে পারলেই মনের শাস্তি ৷ কখন বের হতে পারব এই চিন্তা ৷ তাহলে তারা খাঁটি মুমিনের গুণে গুণান্বিত নয়। এর একটা সুন্দর উপমা দিয়ে বলা হয়েছে,

মসজিদে আসলে মু’মিনের অবস্থা এমন হয় যেমন পানিতে মাছের অবস্থা। আর মুনাফেকের অবস্থা মসজিদে আসলে এমন হয় যেমন খাচার মধ্যে পাখির অবস্থা।

এ হাদীসে বোঝানো হয়েছে- মাছকে যদি পানি থেকে উপরে তুলে ফেলা হয়, ডাঙ্গায় তোলা হয়, তাহলে মাছের ভিতর অস্বস্তি এসে যায় ৷ তার মরণ আবস্থা হয়ে যায় ৷ পানিতে ফিরে যাওয়ার জন্য সে ছটফট শুরু করে দেয় ৷ এর বিপরীত পনিতে ছেড়ে দেয়া হলে তার খুব এতমিনান এসে যায়, স্বস্তি বোধ করতে থাকে । মু’মিনের অবস্থাও এরকম। মসজিদে আসলে তার খুব ভাল লাগে, আর যতক্ষণ বাইরে থাকে, ততক্ষণ তার ভাল লাগে না, আবার মসজিদে আসার জন্য সে ছটফট করতে থাকে।

এর বিপরীত মসজিদে মুনাফেকদের অবস্থা হল পাখিকে যদি খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয় সেই পাখির অবস্থা যেমন । খাঁচায় বন্দী পাখি কোন রকমে একটু ছাড় পেলেই উড়াল দেয়। খাঁচার বাইরে যেতে পারলেই সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তদ্রূপ মুনাফেকদের অবস্থা হল মসজিদ থেকে বের হতে পারলেই যেন সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

আমরা প্রত্যেকেই বুঝি আমাদের কার কলবের হালাত কি! আল্লাহ পাক আমাদের কলবের হালাতকে দোরস্ত করে দেন। সর্বদা মসজিদের সাথে যেন আমাদের দিল লাগা থাকে। আমরা যে আল্লাহর খাস লোক হতে পারি। চতুর্থ প্রকারের লোক হল

৪. পরস্পর মিলিত হওয়া ও পৃথক হওয়া আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য

وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ

অর্থাৎ, ঐ দুই জন লোক, যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবাসে ৷ তাদের ভালবাসা থাকা কিংবা ভালবাসা না থাকা উভয়টা হয় আল্লাহকে কেন্দ্র করে । এখানে বোঝানো হয়েছে- তাদের ভালবাসা দুনিয়ার কোন উদ্দেশ্যে, দুনিয়ার কোন স্বার্থে নয় বরং আল্লাহকে কেন্দ্র করে ।

মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্যই হওয়া উচিত। কোন কিছুকে ভালবাসলে তা আল্লাহর জন্য এবং পরিত্যাগ করলে তাও আল্লাহর জন্য হতে হবে।

“বলুন আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরন সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য। (আন আম-১৩২)

আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ভালবাসা কিংবা আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ভালবাসা বর্জন- এর একটা দৃষ্টান্ত হল

হযরত আলী (রাঃ)-এর একটা ঘটনা

একদিন এক ইয়াহুদী হযরত আলী (রাঃ) -এর সামনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালি দিল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেয়া জঘন্য ধরনের বে-আদবী এবং জঘন্য ধরনের কুফরী। হযরত আলী (রাঃ) বাহাদূর মানুষ। তার সামনে এরকম অবস্থা ঘটছে । তিনি সাথে সাথে লোকটাকে ধরে আছাড় দিয়ে ফেলে দিলেন । তার বুকের উপরে চড়ে বসলেন এবংতলোয়ার নিয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কারণ কাফের মুরতাদকে হত্যাই করে দিতে হয়। লোকটা নীচের থেকে হযরত আলী (রাঃ)-এর মুখে থুথু মেরে দিল। থুথু মারার সাথে সাথে হযরত আলী (রা) লোকটাকে ছেড়ে দিলেন, আর তাকে হত্যা করলেন না।

সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে
সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে

তখন সাথী সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন যে, আপনি তার বুকের উপরে চড়ে বসেছেন, হাতে তলোয়ার, তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন আর এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে দিলেন! থুথু মেরেছে বলে তো আরও বেশী রাগ হয়ে তাড়াতাড়ি তাকে হত্যা করে দেয়ার কথা। হযরত আলী (রাঃ) বললেন যে, আগে তার প্রতি আমার যে রাগ হয়েছিল সেটা ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে রাগ যে, সে আল্লাহর রসূলকে গালি দিয়েছে, আমি মুসলমান হয়ে কী করে বরদাশত করতে পারি! এই রাগটা ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে রাগ। কিন্তু যখনই সে আমার মুখে থুথু দিয়েছে, তখন আমার যে রাগ এসেছে সেটা হল আমার ব্যক্তিগত রাগ। অতএব এ অবস্থায় যদি তাকে হত্যা করি তাহলে সেটা হবে আমার ব্যক্তিগত রাগে হত্যা করা। এটা হবে আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা। বন্ধুত্ব ও শত্রুতা সব আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হওয়া চাই। আগে ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে, আর এবার হল ব্যক্তিগত শত্রুতা, একারণে তাকে ছেড়ে দিয়েছি। দেখা গেল মনের উপরে সাহাবায়ে কেরামের কতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। এটাই হল আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা ও আল্লাহর ওয়াস্তে শত্রুতা।

রাসূল সাঃ এর প্রতি বেলাল রাঃ এর ভালোবাসা

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বেলাল (রাঃ) কে ভালবাসতেন। কি জন্য ভালবাসতেন? বেলালের কোন ধন-সম্পদ ছিল না ৷ বেলাল তো ছিল গোলাম, মুসলমান হওয়ার পরেও তিনি অনেক দিন গোলাম ছিলেন। তার ধন-সম্পদ কিছু ছিল না, আর চেহারাতো হাবশী চেহারা মোটা ঠোট, কাল বর্ণ। এই হাবশী বেলালকে রসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসতেন। কি জন্য তাকে ভালবাসতেন? আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসতেন। বেলাল হাবশীও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসতেন।

কত ভালবাসা ছিল তার একটা ঘটনা শুনুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর বেলাল হাবশী (রাঃ) আর মদীনায় থাকতে পারেননি ৷ যেখানে থেকে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, সেখানে আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখা যাবে না- এটা তিনি সহ্য করতে পারেননি। তিনি মদীনা ছেড়ে কুফায় চরে গেছেন। অনেক দিন আর মদীনায় আসেননি। একদিন স্বপ্নে দেখলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছেন, বেলাল! এ কী জুলুম চলছে? তুমি আমার কাছে আস না কেন? তিনি ঘুম থেকে উঠে পাগলের মত দৌড় দিয়েছেন। সোজা মদীনায় চলে এসেছেন। এই যে বেলাল হাবশীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালবাসতেন, এই ভালবাসার পেছনে দুনিয়ার কোন স্বার্থ ছিল না। এটা ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা ।

যে ব্যক্তির ভালবাসা, শত্রুতা, রাগ, বিদ্বেষ ইত্যাদি মনের সব চেতনা আল্লাহকে কেন্দ্র করে হবে, তার অর্থ হল তার মন সম্পূর্ণ আল্লাহর জন্য নিবেদিত। আর যে ব্যক্তির মন এভাবে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হবে। অবশ্যই সে আল্লাহর খাস মানুষে পরিণত হবে। তাই কেয়ামতের দিন আল্লাহর খাস বান্দা হিসেবে তাকে আরশের নীচে ছায়া দান করা হবে। এই হল চতুর্থ প্রকারের লোক, যাদেরকে আল্লাহ জাল্লা শানুহ কেয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়া দান করবেন ।

আবু উমামা (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেছেন যে ব্যক্তির কাউকে ভালবাসা, ঘৃণা করা, দান করা ও দান না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার। (বুখারী)

ইসলামের জন্যই যুদ্ধের ময়দানে একজন সাহাবীর হাতে তারই কাফের পিতার মৃত্যুর ঘটনা। পঞ্চম প্রকারের লোক হল-

৫. চরিত্রের হেফাজত

وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ‏

অর্থাৎ, ঐ ব্যক্তি যাকে কোন বংশীয়া এবং রূপ সৌন্দর্যের অধিকারীণী নারী যেনার দিকে আহবান
করে আর সে এই বলে যেনা থেকে বিরত থাকে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি । এখানে বোঝানো হয়েছে- ঐ ব্যক্তিও আরশের ছায়া পাবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে তার প্রেমের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। দুনিয়ার কোন সুন্দরী এবং বংশীয়া নারীও যদি তাকে অপকর্মের দিকে আহবান করে, তাহলে সে আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত থাকে। এর অর্থ হল সে তার প্রেমের চেতনাকে, তার যৌন উচ্ছলতাকে আল্লাহর ভয়ে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে।

যৌবনকালে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্য চায়। সৃষ্টিগতভাবে এটা একটা স্বাভাবিক তাড়না। এ সময় কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী কোন রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হবার প্রস্তাব করলে শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়েই তা থেকে বিরত থাকা যায়। আমাদের অনেকের জীবনে এরকম মুহূর্ত আসতে পারে, তখন যদি আমরা আল্লাহর ভয়ে এই পর্যায়টা উত্তীর্ণ হতে পারি তাহলে আমরাও ইনশাআল্লাহ কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া লাভ করতে পারব ৷ যেদিন আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। যাহোক এই হল পঞ্চম প্রকারের লোক, যাদেরকে আল্লাহ জাল্লা শানুহ কেয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়া দান করবেন।

অর্থঃ “আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।” (বনী ইসরাঈল-৩২)
অর্থঃ “লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার নিকটেও যেওনা, তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (আনআম-১৫২)
বিবাহের মাধ্যমে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটানো ইসলামের নির্দেশ।
অর্থ: এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (মুমিনুন-৫-৬) ষষ্ঠ প্রকারের লোক হল-

৬. গোপনে দান করা

وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয় করে এমন গোনপভাবে যে, তার ডান হাত যা ব্যয় করে তার বাম হাত তা জানতে পারে না।

হাতের তো জানার ক্ষমতা নেই। এখানে ডান হাত ব্যয় করে বাম হাত জানতে পারে না- এ বলে বোঝানো হয়েছে যে, কাছের মানুষও জানতে না পারে এভাবে গোপনে ব্যয় করে । এখানে একথা বোঝানো। হয়নি যে, প্রকাশ্যে দান করা নিষেধ এবং প্রকাশ্যে দান করলে হওয়ার পাওয়া যায় না। অবশ্যই নিয়ত যদি ভাল থাকে তাহলে প্রকাশ্যে দান করাতেও হওয়ার পাওয়া যায়। আমি যদি প্রকাশ্যে দান-সদকা করি এই নিয়তে যে, আমার দান-সদকা করা দেখে অন্যরাও দান-সদকা করতে উদ্বুদ্ধ হবে, তাহলে এরকম প্রকাশ্যে দান-সদকা করাও উত্তম।

তবে সাধারণতঃ দান-সদকা করার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে এই রিয়া থাকতে পারে যে, মানুষে আমাকে দান করতে দেখলে আমাকে দানশীল বলবে বা আত্মীয়-স্বজনকে দিলে বলবে আত্মীয়-স্বজনের খুব খোঁজ খবর নেয়, এই ধরনের রিয়ার চিন্তা বা গলত চিন্তা মনের ভিতরে এসে যায়। তাই এখানে গোপনে দান করার কথা বলা হয়েছে, যাতে রিয়ার চিন্তা আসতে না পারে এবং দান সম্পূর্ণ ইখলাছের সাথে হয়, একান্তই আল্লাহকে রজি-খুশী করার জন্য হয়। যারা এরকম একান্তই আল্লাহকে রাজি-খুশী করার। জন্য ব্যয় করবে তারাও আল্লাহর খাস মানুষ কারণ, তারা যেন দুনিয়ার কোন কিছু বোঝে না, দুনিয়ার কোন স্বার্থ বোঝে না, একটু সুনাম হবে, মানুষে একটু ভাল বলবে দুনিয়ার এই সামান্যতম স্বার্থও তারা উদ্ধার করতে চায় না ।

কোন স্বার্থ উদ্ধার করা ছাড়াই নিজের কষ্টে উপার্জন করা সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করল । এমন করলে সে আল্লাহর খাস মানুষে পরিণত হয়, আল্লাহর একান্ত মানুষে পরিণত হয়। তাই খাস বান্দা হিসেবে আল্লাহ পাক আরশের নীচে ছায়া দান করবেন।

মুনাফিকুনের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
“আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করো মৃত্যু আমার আগেই।”
“তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষন না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করবে।” (আল ইমরান-৯২) সপ্তম প্রকারের লোক হল-

৭. আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলা

وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ.

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নির্জনে বসে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার চোখ অশ্রু ঝরাতে থাকে । যে ব্যাক্তি মনের আবেগ মিশিয়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে আর মনে থাকে আল্লাহর চিন্তা-চেতনা, মনে থাকে পরকালের চিন্তা-চেতনা, মনে থাকে জাহান্নামের ভয়, আযাবের না, এই ভয়ে সে কাঁদতে থাকে, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে, এ অবস্থা যার হয়, সে তো আল্লাহর খাস মানুষে পরিণত হয় । তাই কেয়ামতের দিন আল্লাহর খাস বান্দা হিসেবে তাকে আরশের নীচে ছায়া দান করা হবে।

নির্জনে আল্লাহর ভয়ে দু’কারণে অশ্রু বিসর্জনে-

  • ক. আল্লাহর আজমত-জালালাত বা শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের জন্য।
  • খ. নিজের অপরাধ স্মরণ করে মুক্তিলাভের জন্য।

রাসূল (সা:) বলেছেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করেছে তার জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব যেমনি অসম্ভব দোহন করা দুধকে পুনরায় ওলানে প্রবেশ করোনো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার পথে জিহাদ করেছে সে ব্যক্তি আর জাহান্নামের ধোয়া একত্র হবে না।” (তিরমিযী)

রাসূল (সা:) বলেন- “দু’ধরনের চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।

  • ১. ঐ চোখ যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়।
  • ২. ঐ চোখ যা আল্লাহর পথে পাহারাদারীতে রাত জাগে।” (বুখারী)

যিকিরের অর্থগত ব্যাপকতা:

যিকির সকল ইবাদাত অপেক্ষা অধিকতর ব্যাপক।
ইবাদাত ও আদত (প্রাত্যাহিক কাজ-কর্ম ) সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় ও সর্বদা যিকির করা
মুমিনের কর্তব্য। সকল প্রকার ইবাদতেই যিকির রয়েছে। কোন একটি ইবাদতও যিকির থেকে
খালি নয়।

সকল কাজই মূলতঃ আল্লাহর নামেই শুরু করতে হয়। তবেই তাতে বরকত আসে। পাশাপাশি প্রতিটি কাজেই আল্লাহকে স্মরণ করা উচিত এভাবে যে, কাজটি আল্লাহ তায়ালা হালাল করেছেন না হারাম, আর সকল কাজে এই অনুভূতি জাগ্রত করাই প্রকৃত
যিকির।
সাঈদ ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেন, যিকির হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। সুতরাং যে আল্লাহর (আদেশ নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে ) আনুগত্য করল, সে আল্লাহকে স্মরণ
করল। আর যে তাঁর আনুগত্য করল না, সে যিকিরকারী নয়; যদিও অধিক তাসবীহ পাঠ
এবং কুরআন তিলাওয়াত করে।

যিকিরের প্রকারভেদ

  • (১) আল কুরআন তিলাওয়াত, শিক্ষা দান, এর গবেষণা ও বাস্তবায়ন করা।
  • (২) আল্লাহ তায়ালার নাম ও সিফাত (গুণবাচক নাম) সমূহ উল্লেখ করা।
  • (৩) তাঁর প্রশংসা করা।
  • (৪) আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।
  • (৫) তাঁর আদেশ-নিষেধ আলোচনা করা ও শিক্ষা দেয়া।
  • (৬) তার নিয়ামত রাজির স্মরণ করা।
  • (৭) তার নিকট দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।
  • (৮) এ কথা স্মরণ রাখা যে, আল্লাহ তায়ালা
    সর্বদা সাথে আছেন।

হাদীসের বাস্তব শিক্ষা:

বস্তুত: এই সাতটি গুণের প্রতিটি গুণই ছিল উল্লেখিত সাত ব্যক্তির বিশেষ আমল, যার ওয়াসিলায় আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আরশের ছায়াতলে স্থান দিবেন। সুতরাং প্রতিটি মুমিনের সকল সৎ আমলের পাশাপাশি একটি বিশেষ আমল থাকা অবশ্যই জরুরী ৷ যা হবে একশতভাগ ইখলাস সহকারে। আর সেই গুণ যদি হয় উপরোক্ত গুণাবলীর একটি তবেই কিয়ামতের ভয়াল চিত্রের সম্মুখীন হতে হবে না; বরং আল্লাহ তায়ালা তাঁর আরশের নীচে ছায়া দানের মাধ্যমে সকল প্রকার ভয় থেকে নিরাপত্তা দান করবেন এবং পরিশেষে জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সেই সাতশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করুন।

এই হল সাত শ্রেণীর মানুষ। ইনসাফদার শাসক, যৌবন বয়সে যারা ইবাদত করে, যাদের অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে লাগানো থাকে, যারা একে অপরকে ভালবাসে কিংবা ভাল না বাসে এটা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়, যারা আল্লাহর জন্য দুনিয়ার প্রেমকে বিসর্জন দেয় এবং যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, যারা রিয়া মুক্ত হয়ে একান্তই আল্লাহকে রাজি-খুশী করার জন্য সম্পূর্ণ এখলাছের সাথে সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা মনের আবেগ মিশিয়ে গোপনে আল্লাহর যিকির করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে থাকে।

আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিসের দারস pdf

শীঘ্রই পিডিএফ তৈরী করে লিংক দিবো ইনশাআল্লাহ ৷ আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন এই সাত প্রকারের লোককে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। আরশের নীচে ছায়া দান করবেন তার কি অর্থ? তার এই অর্থ হতে পারে না যে, কেয়ামতের ময়দানে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন পরে আবার জাহান্নামে পাঠাবেন। এ অর্থ হতে পারে না। বরং তারা আল্লাহর খাস মানুষ, তাই প্রথম থেকেই তাদেরকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া শুরু হবে। ময়দানে গরমের কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আরশের নীচে ছায়া দেয়া হবে, তারপর জাহান্নামের কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য জান্নাতে পাঠানো হবে। তবে হাঁ ফরয, ওয়াজিব ইত্যাদি জরুরী ইবাদতগুলো অবশ্যই ঠিক থাকতে হবে। ফরয, ওয়াজিব ইত্যাদি জরুরী কাজগুলো করার পর এই আমলগুলো থাকলে এর ওছীলায় আল্লাহ পাক তাকে ময়দানে হাশরে আরশের নিচেয় ছায়া দান করবেন তারপর জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এই সাত শ্রেণীর লোকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমাদের জন্য যেন আরশের নীচেয় ছায়া বরাদ্দ হয়। আমীন!

আরশের নিচে ছায়া ৷ আরশের নিচে ছায়া পাবে
আরশের নিচে সাত ব্যক্তি ৷ 7 ব্যক্তি আরশের নিচে ছায়া পাবে ৷ সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে ৷ আরশের নিচে ছায়া সংক্রান্ত হাদিসের দারস pdf
সাত ব্যক্তি আরশের নিচে ছায়া পাবে ৷
আরশের নিচে ছায়া পাবে কারা?

শেষ কথা

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে
সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে

One thought on “সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়া পাবে | মাওলানা দীদার মাহদী

  1. হাদিসের ব্যাখ্যায়, যে হাদিসগুলো দেওয়া হয়েছে তার রেফারেন্স নাম্বার সহ আরবি এবারত উল্লেখ করলে আরো ভালো হতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *