বদলি হজ করার নিয়ম কানুন
দীদার মাহদী
ইসলাম একটি সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ৷ মানুষের সহজাত ও জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম ৷ ইসলামের ইবাদাতগুলো কোনোটা আর্থিক এবং কোনোটা শারীরিক ৷ সালাত শারীরিক ৷ যাকাত আর্থিক ৷ হজ এমন একটি ইবাদাত যা উভয়টিকে একত্রিত করেছে ৷ এ কারণে হজের ফজিলতও অনেক বেশি ৷ এমনকি জিহাদের মত ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে ৷ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিবেদিতভাবে, সর্বপ্রকার পাপ, অন্যায় ও অশ্লীলতামুক্ত হয়ে হজ আদায় করলো, সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরলো’ (বুখারী, হাদিস: ১৫২১; মুসলিম, হাদিস : ১৩৫০)।
হজে সারাবিশ্বের আল্লাহপ্রিয় মানুষের জমায়েত হয় ৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের সম্মিলন ঘটে ৷ যার ফলে হজের আমলগুলো করতে মোটামুটি একটু কষ্টই হয় ৷ এ কারণে আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও কারো কারো শারীরিক সক্ষমতা থাকে না ৷ যার ফলে তার দায়িত্বে হজের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল থেকে যায় ৷ ইসলাম মানুষের সহজাত ধর্ম হওয়ায় এক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছে ৷ যাকে বদলি হজ বলে ৷ আর বদলি হজ বললেই আমাদের মাথায় আসে এর নিয়ম কানুন বোধহয় আলাদা ৷ কিন্তু না ৷ হজ আদায়ের নিয়ম একই ৷ তবে কিছু মাসআলায় ভিন্নতা আছে ৷ বিশেষত নিয়তের ক্ষেত্রে ৷
বদলি হজের বিধান
শারীরিক সক্ষমতা থাকলে বদলি হজ করা বৈধ নয় ৷ কেবল আর্থিক সচ্ছলতা আছে কিন্তু এমন অসুস্থ যে হজ আদায়ে সক্ষম নয় এমন ব্যক্তির পক্ষেই বদলি হজ জায়েজ ৷ বৃদ্ধ হওয়ার কারণে শারীরিক দুর্বলতা, কোনো মারাত্মক অসুস্থতা, পঙ্গু হয়ে যাওয়া, অন্ধ হয়ে যাওয়া, যে সব নারীদের মাহরাম নেই এবং কোনো কারণে নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, বিদায় হজ্বে খাছআম গোত্রের একজন নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবার উপর হজ ফরয হয়েছে, কিন্তু তিনি এত বৃদ্ধ যে, বাহনের উপর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেন না। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারব?’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ। (তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারবে)।’-সহীহ বুখারী ১/২০৫; সহীহ মুসলিম ১/৪৩১
হযরত আলী রা. অতিশয় বৃদ্ধ লোক সম্পর্কে বলেছেন- ‘সে তার পক্ষ থেকে হজ্ব করাবে এবং এর খরচ বহন করবে’।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/৫৯৯
আরও পড়ুনঃ জিলহজের প্রথম দশকের আমল
উক্ত হাদীস দুটোর মাধ্যমে বদলি হজের বৈধতা সুস্পষ্ট ৷ ইসলাম মানবতার ধর্ম ৷ তাই মানুষের অসুবিধার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে ওজর কবুল করেছে ৷
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, জুহায়না গোত্রের এক নারী নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমার মা হজের মানত করেছিলেন কিন্তু তা আদায় করার আগেই তিনি মারা গেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করবো?
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হ্যাঁ’, তার পক্ষ থেকে তুমি হজ করবে। যদি তার কোনো ঋণ থাকে তবে কি তুমি তার ঋণ পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর ঋণ পরিশোধ কর। কেননা আল্লাহ তাআলাই পাওনা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার।’ (বুখারি)
কিন্তু যদি কেউ উল্লিখিত ওজরগুলোর কারণে নিজে জীবিত থাকা অবস্থায় নিজের ফরজ হজ অন্যের মাধ্যমে বদলি হজ হিসেবে করিয়ে ফেলেন, এরপর যদি তিনি আবার শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পান, তাহলে তার পূর্ববর্তী কৃত বদলি হজ বাতিল হয়ে তা নফল হজ হিসেবে গণ্য হবে। উপরন্তু তাকে নিজের ফরজ হজ নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে।
বদলি হজ কোন প্রকারের হবে?
হজ তিন প্রকার ৷ ১. ইফরাদ, ২. তামাত্তু ও ৩. কিরান ৷ এখন বদলি হজ আদায়াকারী কোনটা আদায় করবে? সহজ কথা হলো, যার পক্ষ থেকে হজ আদায় করা হবে তিনি যেটা বলবেন সেটাই আদায় করতে হবে ৷ অর্থাৎ যদি তিনি ইফরাদ করতে বলেন তাহলে ইফরাদ করতে হবে, যদি কেরান করতে বলেন তাহলে কেরান করতে হবে, আর যদি তামাত্তু করতে বলেন তাহলে তামাত্তু করতে হবে। এর অন্যথা হলে হবে না। বদলি হজ ইফরাদ হজ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
বদলি হজের উপযুক্ত কে?
কাকে দিয়ে বদলি হজ করানো যাবে? যার ওপর হজ ফরজ এবং সে নিজে হজ আদায় করে নিয়েছে তবে তাকে দিয়ে বদলি হজ করানো যাবে ৷ নিজে ফরজ হজ আদায় না করলে তার দ্বারা বদলি হজ করানো যাবে না ৷ হজ একটি ইবাদাত ৷ হজের নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানাশোনা ব্যক্তির মাধ্যমে হজ করানো উত্তম ৷ এক্ষেত্র কোনো দীনদার আলেমকে বেছে নেয়া যেতে পারে ৷ এটিই ভালো হয় ৷ হজের প্রচন্ড আগ্রহ রয়েছে কিন্তু অর্থাভাবে যেতে পারছে না এমন কাউকে নির্বাচন করাও যেতে পারে ৷ স্বামী বা যথাযথ অভিভাবকের অনুমতি থাকলে এবং মাহরাম পুরুষ সঙ্গে থাকলে নারীরাও বদলি হজে যেতে পারবে।
কোনো নারীর পক্ষ থেকে বদলি হজ করাতে হলে অন্য নারী দিয়েই করাতে হবে এমন কোনো আবশ্যকতা নেই। বরং নারীর পক্ষ থেকে পুরুষও বদলি হজ করতে পারবে এবং পুরুষের পক্ষ থেকে নারীও হজ করতে পারবে।
মৃত ব্যক্তির সম্পদ দিয়ে বদলি হজ
যার হজ করার সামর্থ্য ও সক্ষমতা ছিল, কিন্তু হজ করেনি। এক পর্যায়ে হজ করার সক্ষমতা হারিয়ে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তার কর্তব্য নিজের পক্ষ থেকে বদলি হজ করানো অথবা মৃত্যুর সময় বদলি হজ করানোর অসিয়ত করে যাওয়া। মৃত ব্যক্তি অসিয়ত করে গেলে তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে তার জন্য বদলি হজ করানো ওয়ারিসদের ওপর ওয়াজিব।
কেউ যদি হজ করানোর অসিয়ত না করে মারা যায়, তার পক্ষ থেকেও বদলি হজ করা যায়। বদলি হজের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির জিম্মায় থাকা হজ আদায় হবে এ আশাও করা যায়। বুরাইদাহ (রা.) বলেন, এক নারী রাসুলের (সা.) দরবারে গিয়ে বললেন, আমার মা হজ না করেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারি? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ করো। (সুনানে তিরমিজি: ৯২৯)
তবে মৃত ব্যক্তি হজ করানোর জন্য অসিয়ত না করে গেলে তার এজমালি বা অবণ্টিত সম্পদ থেকে তার বদলি হজ করানো যাবে না। মৃতের যে আত্মীয় বা সন্তানরা হজ করানোর উদ্যোগ নেবেন, হজের ব্যয় তাদের বহন করতে হবে।
আল্লাহ আমাদের হাজ্জে মাবরূর নসীব করুন ৷ নিজের হজ নিজেই আদায় করার তাওফিক দান করুন ৷
লেখকঃ প্রধান শিক্ষক, দারুলহুদা মডেল মাদরাসা, কোদালপুর, গোসাইরহাট, শরীয়তপুর ৷