এতিম কাকে বলে | ইয়াতিমের অধিকার

এতিম কাকে বলে | ইয়াতিমের অধিকার

ইসলাম দয়া ও ভালোবাসার ধর্ম। এই ধর্ম হৃদয়ে আশার প্রদীপ প্রজ্বালন করে। অসহায়ের দায়িত্ব নিতে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। এই ধর্মের মহান শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের অধিকারী হলে নিজের ও পরিবারের পাশাপাশি সমাজের দায়িত্বও পালন করতে হবে। বিশেষ করে ইয়াতীম ও অসহায়দের অধিকারের ব্যাপারে ইসলামে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। ইয়াতীমদের প্রতিপালন, তাদের দেখাশুনা ও পুনর্বাসন ইত্যাদি ইসলামে অত্যাধিক সওয়াবের কাজ বলে গণ্য।

আরও পড়ুনঃ কোন সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাবে

ইয়াতিম/এতিম কাকে বলে?

ইসলামের দৃষ্টিতে পিতৃহীন শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ইয়াতিম হিসাবে গণ্য হয়। বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর তাকে আর ইয়াতিম বলা হয় না। হানযালা ইবনে হুযাইম আল হানাফী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন,

لا يُتْمَ بعد احتلامٍ ، ولا يُتْمَ على جاريةٍ إذا هي حاضَتْ

স্বপ্নদোষ হলে কোন ছেলে শিশু ইয়াতিম থাকে না আর ঋতুস্রাব হলে কোন মেয়ে শিশু ইয়াতিম থাকে না। (সিলসিলা সহীহাহ ৩১৮০)

এতিম কাকে বলে | ইয়াতিমের অধিকার
এতিম কাকে বলে | ইয়াতিমের অধিকার

অনাথ অর্থ কি?

এতিম শব্দটি আরবি শব্দ যার অর্থ নি:সঙ্গ। আর অনাথ অর্থ হল অভিভাবকহীন, নিরাশ্রয়, অসহায় ইত্যাদি ৷

এতিম নিয়ে হাদিস

সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব [তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন]।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫৩০৪)। এতিমের সাহায্যকারী মর্যাদা সম্পর্কে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না।’ (মুসলিম, হাদিস নং- ৫২৯৫)

এতিমদের নিয়ে উক্তি

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১৮২৫২)

অন্যত্র নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিমদের ঐ বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঐ বাড়ি, যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়।’ অতঃপর তিনি তার অঙুলির মাধ্যমে বলেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩৬৭৯)।

এতিমদের নিয়ে কোরআনের আয়াত

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘(হে নবি) আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।’ (সুরা দুহা, আয়াত-৮)

ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আহারের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও (আল্লাহর ভালোবাসায়) অভাবী, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। (এবং তারা বলে) শুধু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার্য দান করি। বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না।’ (সুরা দাহর, আয়াত-৮, ৯)।

ইয়াতীমের পরিচয়

ইয়াতীম শব্দের অর্থ নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ। বাংলা অভিধান অনুযায়ী, মাতাপিতাহীন বালক-বালিকাকে ইয়াতীম বলা হয়। ইসলামি পরিভাষায়, যে শিশুর পিতা ইন্তেকাল করেছেন, শুধু তাকে ইয়াতীম বলা হয়। পিতা উপস্থিত থাকা অবস্থায় মাতাবিহীন শিশুকে ইসলামি পরিভাষায় ইয়াতীম বলা হয় না। কেননা সন্তানের লালন-পালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পিতার। তাই শিশুকে তখনই নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ ধরা হবে, যখন পিতা থাকবে না। মাতার অবর্তমানেও এই দায়িত্বভার পিতার ওপর অর্পিত। তাই মাতাবিহীন শিশু নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ নয়। আর সন্তান যখন বালেগ হয়ে যায়, তখন তাকে ইয়াতীম বলা হয় না। কেননা সে তখন স্বনির্ভর।

পবিত্র কুরআনে ইয়াতীমের মর্যাদা

ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণে মর্যাদা ও নির্দেশনা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡیَتٰمٰی ؕ قُلۡ اِصۡلَاحٌ لَّہُمۡ خَیۡرٌ ؕ

অর্থাৎ, “তারা তোমাকে ইয়াতীম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, তাদের ইসলাহ তথা সুব্যবস্থা (পুনর্বাসন) করা উত্তম। (সুরা বাকারা-২২০)

যারা ইয়াতীমের প্রতি অবিচার করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ভর্ৎসনা করে বলেন,

کَلَّا بَلۡ لَّا تُکۡرِمُوۡنَ الۡیَتِیۡمَ ﴿ۙ۱۷﴾

অর্থাৎ, “অসম্ভব (কখনোই নয়, বরং তোমরা ইয়াতীমের সম্মান রক্ষা করো না।” [সুরা ফাজর-১৭]

মক্কার কুরাইশরা ইয়াতীমদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করত। বাবা মারা গেলে চাচা এসে ভাতিজার সমুদয় সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজ উপরে হজম করে ফেলত। আল্লাহ তায়ালা তাদের এই মন্দ কর্ম নিষিদ্ধ করেন। ইয়াতীম ও অনাথকে ধমক দেওয়াও ইসলাে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “তুমি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হয়ো না।” (সুরা দুহা-৯)

হাদীসে ইয়াতিমের মর্যাদা

হাদিসে ইয়াতীমের মর্যাদা সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমি ও ইয়াতীম। প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন)।” (বুখারি)

ইয়াতীমের মর্যাদা সম্পর্কে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “বিধবা, ইয়াতীম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। (মুসলিম)

ইসলামের দৃষ্টিতে ইয়াতীমের প্রতিপালন জান্নাতে যাওয়ার উপায়। হাদিস শরিফে এসেছে, “যে ব্যক্তি কোনো ইয়াতীমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।” (মুসনাদে আহমাদ) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, “মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে ইয়াতীম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ি, যে বাড়িতে ইয়াতীম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। ” (ইবনে মাজাহ)

ইয়াতীমের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব দিকনির্দেশনার পূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে ইয়াতীম শিশুরা মানবিক মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করতে পারবে। তাহলে সমাজ হবে সুখী, শান্তিময় ও সুশৃঙ্খল।

ইয়াতিমের অধিকার

ইসলামি জীবন বিধানে মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। ইসলাম সদাচরণের শিক্ষা দেয়। ইসলাম শিক্ষা পরস্পরকে ভালোবাসতে। কেউ যেন কাউকে কোন ভাবে কষ্ট না দেয় এবং কারো প্রতি জুলুম অত্যাচার না করে, মানুষকে সেই নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। অসহায়ের দায়িত্ব নিতে উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষ করে সমাজের ইয়াতীম, দুস্থ ও অসহায়দের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইয়াতীমদের প্রতিপালন, তাদের দেখাশুনা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত ইসলামের নীতিমাল তাদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে।

ইসলামে ইয়াতীমের অধিকার

ইসলামে ইয়াতীমের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত আলোচিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

২. ইয়াতীমের উপর জোরজবরদস্তি করা নিষিদ্ধ। তাদের উপর কোনরূপ জোর করা যাবে না।

৩. ইয়াতীমের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

8. ইয়াতীমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাদের সাথে কোনরূপ খারাপ আচরণ করা যাবে না। এমনকি তাদের সাথে ধমকের সহিত কথা বলাকেও পবিত্র কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে।

৫. ইয়াতীমের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৬. নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৭. বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সহায়-সম্পত্তি সংরক্ষণ করতে হবে।

৮. ইহসান বা ভালো ব্যবহারের অধিকার।

৯. ইনসাফ বা ন্যায়সংগত বিচারের অধিকার।

১০. যেসব সম্পদ কাফিরদের সঙ্গে বিনা যুদ্ধে মুসলিমদের হস্তগত হয় (যেমন- খারাজ, জিজিয়া ইত্যাদি) সেসব সম্পদের উপ ইয়াতীমের অধিকার রয়েছে।

শেষ কথা

আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ইয়াতীম শিশুর প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ইসলামে তার যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েে সমাজে সেসব অধিকারের যথাযথ বাস্তবায়ন করা কালে তারা পূর্ণ অধিকার নিয়ে সমাজে বসবাস করতে পারবে। তাদের মানবিক ও সামাজি মর্যাদার পাশাপাশি সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। তাহলেই কেবল সুখী, শান্তিময় ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

দীদার মাহদী 

এতিম কাকে বলে | ইয়াতিমের অধিকার
এতিম কাকে বলে | ইয়াতিমের অধিকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *