ইস্তেগফার, তাওবা ও তাসবিহ | কখন ফেরেশতারা দোয়া করে
আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু ৷ সুপ্রিয় পাঠক! আশা করছি ভাল এবং সুস্থ আছেন ৷ নিরাপদে আছেন ৷ আজ আমরা কথা বলবো ইস্তেগফার, তাওবা ও তাসবিহ | কখন ফেরেশতারা দোয়া করে এই বিষয়ে ৷ পুরো আর্টিকেলটি পড়লে তাওবা ইস্তেগফার সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন থাকবে না ইনশাল্লাহ ৷
আরও পড়ুনঃ মৃত মা-বাবার জন্য করণীয় আমল কী?
ইস্তেগফার, তাওবা ও তাসবিহ | কখন ফেরেশতারা দোয়া করে
ইস্তেগফার ও তাসবীহ
ইস্তেগফার শব্দটির মূলধাতু হলো গাইন ফা রা ( غ-ف-ر) এর শাব্দিক অর্থ: ক্ষমা প্রার্থনা করা বা মাফ চাওয়া ৷
তাওবা অর্থ গুনাহ থেকে আনুগত্যের দিকে এবং গাফলত থেকে আল্লাহর স্মরণের দিকে ফিরে আসা ৷ আর ইস্তেগফার অর্থ ক্ষমা চাওয়া ৷ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ৷ প্রত্যেকের উপর কৃত পাপ থেকে তওবা ইস্তেগফার করা ওয়াজিব ৷
তাসবীহ মানে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা। আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা। ইস্তেগফার মানে, আস্তাগফিরুল্লাহ বলা। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
ফিরিশতাগণ তাসবীহ পাঠ করেন। ইস্তেগফার করেন না। কারণ তাদের গুনাহ নেই। তারা মানুষের জন্য ইস্তেগফার করেন। আমাদের গুনাহ হলে, তাসবীহের চেয়ে ইস্তেগফার বেশি করা করা জরুরী।
وَٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ یُسَبِّحُونَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ وَیَسۡتَغۡفِرُونَ لِمَن فِی ٱلۡأَرۡضِۗ
ফেরেশতাগণ তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ করে এবং পৃথিবীবাসীর জন্য ইসতিগফার করে ৷ (সূরা শুরা:৫)
তওবা করার সঠিক পদ্ধতি
তাওবা করার জন্য মোট পাঁচটি কাজ করতে হবে ৷
- খাঁটি অন্তরে তাওবা করতে হবে ৷ শুধুমাত্র আল্লাহর আযাবের ভয় ও তাঁর নির্দেশের গুরুত্বকে সামনে রেখে তাওবা করতে হবে ৷
- অতীতের পাপের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে ৷
- উক্ত অপরাধ থেকে এখনই বিরত হতে হবে ৷
- ভবিষ্যতে এই গোনাহ না করার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে ৷
- আল্লাহর হক বা বান্দার হক নষ্ট হয়ে থাকলে তার সংশোধন ও প্রতিকার করতে হবে ৷ যেমন: নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত ইত্যাদি আল্লাহর হক ৷ এসব আদায় না করলে তা আদায় করতে হবে ৷
আর বান্দার হক এর মধ্যে অর্থ সম্পদ বিষয়ক হক নষ্ট করে থাকলে ৷ উক্ত অর্থ বা সেই পরিমাণ অর্থ হকদারের নিকট বা তার মৃত হয়ে থাকলে সে ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের নিকট ফেরত দিতে হবে ৷ ফেরত দেয়া সম্ভবপর না হলে তাদের থেকে মাফ করিয়ে নিতে হবে ৷ আর অর্থ-সম্পদ ব্যতীত অন্য কোন হক নষ্ট করে থাকলে ৷ যেমন: গীবত বা গালিগালাজ করে থাকলে ৷ বা মুখ দিয়ে কথার মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে থাকলে ৷ তার থেকে মাফ করিয়ে নিতে হবে ৷
কোন ফিতনার আশংকা না থাকলে উক্ত অন্যায় উল্লেখপূর্বক ক্ষমা চাইতে হবে ৷ অন্যথায় উল্লেখ করা ছাড়াই ক্ষমা চাইতে হবে ৷ তার মধ্যেও ফিতনার আশংকা থাকলে শুধু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে ৷ নেক কাজ করবে এবং দান-সদকা করবে ৷ আর হকদার ব্যক্তি হলে তার উদ্দেশ্যে কিছু সাদাকা করে দিবে ৷
উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা ব্যতীত শুধু গতানুগতিকভাবে মুখে তওবা ইস্তেগফার বাক্য উচ্চারণ করলেই তাওবা হয়ে যায় না ৷ যদিও শুধু মুখে উচ্চারণ ফায়দা রয়েছে ৷ তবুও মুখে মুখে বলার দ্বারা তাওবা হয়ে যায় না ৷ বরং তার জন্য এই পাঁচটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে ৷
আরও পড়ুনঃ ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত
সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার
(اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ )
উচ্চারণ:“আল্লাহুম্মা আনতা রব্বী লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্কতানী ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আহ্দিকা ওয়া ও’য়াদিকা মাসতাত’তু আ’উযুবিকা মিন শার্রি মা ছা’নাতু আবূউলাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়্যা ওয়া আবূউলাকা বিযানবী ফাগ্ফির্লী ফাইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয্যুনূবা ইল্লা আনতা”
অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ছাড়া কোন উপাস্য নাই, আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, এবং আমি আপনার বান্দা, এবং আমি সাধ্য অনুযায়ী আপনার ওয়াদা ও অঙ্গিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি, আমি নিজের আমলের অনিষ্টতা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি ৷
আমি নিজের উপর আপনার নিয়ামত সমূহ স্বীকার করছি। আমি স্বীয় গোনাহের স্বীকার করছি। সুতরাং আপনি আমাকে মাফ করুন। কেননা আপনি ব্যতিত গোনাহ মাফ করার মতো আর কেউ নেই।
সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার হাদীস
قَالَ حَدَّثَنِي شَدَّادُ بْنُ أَوْسٍ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم سَيِّدُ الِاسْتِغْفَارِ أَنْ تَقُولَ اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلٰى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّه“ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ قَالَ وَمَنْ قَالَهَا مِنْ النَّهَارِ مُوقِنًا بِهَا فَمَاتَ مِنْ يَوْمِه„ قَبْلَ أَنْ يُمْسِيَ فَهُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَمَنْ قَالَهَا مِنْ اللَّيْلِ وَهُوَ مُوقِنٌ بِهَا فَمَاتَ قَبْلَ أَنْ يُصْبِ فَهُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ.
শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাঃ) থেকে বর্ণিত :
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার হলো বান্দার এ দু’আ পড়া-
“হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে কৃত প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।
তুমি আমার প্রতি তোমার যে নি’য়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।”
যে ব্যক্তি দিনে (সকালে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ ইসতিগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হবার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে (প্রথম ভাগে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ দু’আ পড়ে নেবে আর সে ভোর হবার আগেই মারা যাবে সে জান্নাতী হবে। (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৮৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৭৫৪)
ফেরেশতারা যখন বান্দার জন্য ইস্তেগফার করে
আমরা মা-বাবার কাছে দোয়া চাই। পীর-বুযুর্গ-শায়খের কাছে দোয়া চাই। ময়মুরুব্বি, ওস্তাদের কাছে দোয়া চাই। আমি চাইলে ফিরিশতাগণেরও দোয়া লাভ করতে পারি। অত্যন্ত সহজেই। আট সময়ে ফিরিশতাগণ আমার জন্য দোয়া করতে থাকেন ৷
১. আমি যখন প্রথম কাতারে নামাজে দাঁড়াই। যতক্ষণ এই কাতারে থাকব, ততক্ষণ ফিরিশতাগনের দুর্লভ দোয়া পেতে থাকব ৷ (সহীহ তারগীব তারহীব ৪৯১)
২. আমি যখন সলাতের অপেক্ষায় মসজিদে বা জায়নামাজে বসে থাকি। আমি যখন ফরজ নামাজের পর মসজিদে বসে থাকি। যতক্ষণ বসে থাকব, ততক্ষণ ফিরিশতাগন আমার জন্য দোয়া করতে থাকবেন ৷ (মুসলিম ৬৪৯)
৩. অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেলে। ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকে, অসুস্থ্যকে দেখে ঘরে ফেরা পর্যন্ত নিষ্পাপ ফিরিশতাগন আমার জন্য দোয়া করতে থাকবেন ৷ (সিলসিলা সহীহাহ ৩৪৭৬)
৪. শুধু আল্লাহর জন্য, আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য, কোনও মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করতে গেলে। বাড়ি ছেড়ে বের হওয়া থেকে শুরু করে, বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমি ফিরিশতাগনের বরকতময় দোয়ায় শামিল থাকব ৷ (মুসলিম ২৫৬৭)
৫. মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অনুপুস্থিতিতে দোয়া করার সময় ফিরিশতাগন আমার জন্য দোয়া করতে বসে যান। বিশ্ব মুসলিমের জন্য, নিজের ভাই-বেরাদরের জন্য দোয়া করার সময় খেয়াল রাখব, আমি যত বেশি সময় তাদের জন্য দোয়ায় মশগুল থাকব, তত বেশি সময় আমি ফিরিশতাগনের দোয়ার চাদরে মোড়ানো থাকব ৷ (মুসলিম ২৭৩২)
৬. মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা দেয়া সময়। সেটা হতে পারে একটি ভাল কথা, একটি ভাল কাজ, একটি উপকারী তথ্য, একটি দরকারি টিপস। সুযোগ পেলেই ফিরিশতাগনের দোয়া নেয়ার চেষ্টা করতে ত্রুটি করব না ৷ (জামে সগীর ৫৮৪১)
৭. ওজু বা পবিত্র অবস্থায় ঘুমুলে। ঘুমের আগে ওজু করতে অলসতা লাগে? উপকারটা একটু চিন্তা করে দেখি? সামান্য কষ্ট করে ওজু করলে, একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে ফিরিশতাগণ আমার জন্য দোয়া করেই যাবেন। দোয়া করেই যাবে। কী অসাধারণ সুযোগ ৷ (তারগীব তারহীব ৫৯৯)
৮. সাহরী খাওয়ার সময়। ফিরিশতাগনের দোয়ার আশায় হলেও সাহরী খাওয়ার সময়টা যথাসম্ভব দীর্ঘ করব। দীর্ঘ করার প্রক্রিয়াটা এভাবেও হতে পারে, সাহরির মূল খাবার গ্রহনের বেশ আগে, সাহরির নিয়তে একঢোঁক পানি পান করে নিলাম। তারপর মূল খাবার খেলাম। তারপর একেবারে শেষ সময়ে একটা খেজুর খেলাম। তাহলে দীর্ঘ সময় দোয়া পাবো ৷ (জামে সগীর ১৮১০)
রাব্বে কারীম বেশি বেশি ফিরিশতাগণের অমূল্য দোয়া হাসিল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
শেষ কথাঃ
সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷ ফেসবুকে আমাদের সাথে যুক্ত হোন ৷ ক্লিক করুন ৷
মাশাআল্লাহ ! অনেক চমৎকার একটি আর্টিকেল পড়লাম।নিয়মিত লিখুন। আপনার ইলম দ্বারা উপকৃত হচ্ছি।জাযাকুমুল্লাহ খাইর। আল্লাহ আপনার হায়াতে বারাকা দিন।আপনারা ইলমে বারাকা দিন।
শুকরিয়া ৷ আপনার জন্যও দুআ ৷ ইনশাআল্লাহ নিয়মিত লেখা পাবেন ৷
আলহামদুলিল্লাহ। চমৎকার একটি লেখা পড়লাম। জাযাকাল্লাহ খাইরান।