শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা

শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা

মহান আল্লাহ তাআলা ইমানদারদের অনেক বরকতময় দিন-রাত ও ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ দান করেছেন। ইবাদতের এসব উর্বর সময়কে যথাযথভাবে ঐকান্তিকতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারলে— সামান্য সাধনা, ক্ষুদ্র পরিশীলন ও অনুশীলনের মাধ্যমে প্রশান্তির বারিধারায় সিক্ত হতে পারে। অর্জন করতে পারবেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অনুকম্পা। সেসব রাতের অন্যতম একটি হলো- পবিত্র শবে বরাত।আমরা বক্ষমাণ নিবন্ধে শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ ৷

আরও পড়ুনঃ ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? 

শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা

শাবান মাসের ফজিলত রমজান মাস হলো নেকী অর্জনের প্রতিযোগিতার মাস। এই প্রতিযোগিতা শুরু করার প্রস্তুতি শাবান মাস থেকেই শুরু হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- শাবান মাসের নাম এ জন্য শাবান রাখা হয়েছে যে, এতে রমজানের জন্য বেশি বেশি পুণ্য প্রকাশ পায়। সৎকাজ প্রকাশ পায়। আর রমজানকে এ জন্য রমজান নাম রাখা হয়েছে যে, এটা গুনাহকে জ্বালিয়ে দেয়। ‘(কানজুল উম্মাল)

 

হযরত সালমান ফারসী রা. থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসের শেষে আমাদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন- হে লোকসকল, তোমাদের মাথার উপর ছায়াস্বরূপ একটি মহান বরকতময় মাস আসছে। এই মাসে এমন একটি রাত আছে, যা এক হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। এই মাসের রোজাকে আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর ফরজ করেছেন এবং রাত্রির নামাজ (তারাবিহ) তোমাদের জন্যে সাওয়াবের কাজ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এই মাসে কোনো নফল আদায় করলো, সে যেন রমজানের বাইরে একটি ফরজ আদায় করলো। আর যে এই মাসে একটি ফরজ আদায় করলো, সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করলো। এটা সবরের মাস। আর সবরের পুরস্কার একমাত্র জান্নাত। এই মাসটি মানুষের প্রতি মানুষের মাসে মুমিনদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া সয়াম থকানো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ব্যক্তির জন্যে তা গুনাহ মাফের এবং দোজখ থেকে নাজাতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং সেই রোজাদারের সমান সাওয়াব সে ব্যক্তি লাভ করবে।

শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা
শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করলেন, যে ব্যক্তি একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি অথবা এক চুমুক দুধ দিয়ে কাউকে ইফতার করাবে, তাকেও আল্লাহ তাআলা এই সাওয়াব দান করবেন। এটা এমন একটি মাস যার প্রথম অংশে রহমত, মধ্যম অংশে মাফফেরাত এবং শেষ অংশে দোজখ থেকে নাজাত রয়েছে। যে ব্যক্তি এই মাসে নিজের অধিনস্তদের (কাজের) বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন এবং দোজখ থেকে রক্ষা করেন। এই মাসে চারটি কাজ বেশি করে করো। তার মধ্যে দুইটি কাজ দ্বারা তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করতে পারবে এবং অপর দুইটি কাজ যা না করে তোমাদের কোনো উপয় নেই। অতঃপর যে দুইটি দ্বারা তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করবে সেই দুইটি হলো, কালেমা শাহাদাত পড়া এবং এস্তেগফার করা। আর যে দুইটি কাজ না করে তেমাদের কোনো উপায় নেই সেই দুইটি হলো, আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করা এবং দোজখ থেকে পানাহ চাওয়া। যে ব্যক্তি রোজাদারকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাকে আমার হাউজ থেকে এমনভাবে পান করাবেন যে, বেহেশতে প্রবেশ করা পর্যন্ত পিপাসা লাগবে না। (বায়হাকি শরিফ)

 

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. বলেন- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শাবান মাসে এত বেশি রোজা রাখতে দেখেছি যে, অন্য কোনো মাসে এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি।

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখাটা উম্মতের জন্যে সুন্নাত নয়। অর্থাৎ আমরা যদি তাঁর অনুসরণ করতে গিয়ে বিরতিহীনভাবে শাবান ও রমজান একত্রে রোজা রাখি, তবে এভাবে রোজা রাখতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। বিষয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘ছাওমে বেছাল’ এর মর্যদা সম্পন্ন। অর্থাৎ সারা বছরই তিনি কিছু কিছু বিরতি দিয়ে রোজা রাখতেন। তাঁর দৈহিক ও রূহানী শক্তি ছিল উম্মতের শক্তির চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এই জন্যে তিনি ‘ছাওমে বেছাল’ অর্থাৎ বিরতিহীনভাবে রোজা রাখতে উম্মতকে নিষেধ করেছেন। কারণ শাবান ও রমজান দুই মাস বিরতিহীনভাবে রোজা রাখলে দুর্বলতার আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য আমাদেরকে শাবান মাসের বরকত হাছেল করা থেকে একেবারে বঞ্চিত রাখা হয়নি। এতটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে, শাবান মাসের প্রথমার্ধে যদি আমরা রোজা রাখতে চাই, তবে রাখতে পারি। অর্থাৎ শাবান মাস অর্ধেক হয়ে গেলে আর নফল রোজা রাখার অনুমতি নেই। ইরশাদ হয়েছে-

 

إِذَا انْتَصَفَ الشَّعْبَانُ فَلَا تَصُومُوا

 

অর্থ : যখন শাবান মাস অর্ধেক হয়ে যায়, তখন তোমরা আর রোজা রেখো না।

 

(আবু দাউদ, তিরমিযী) অর্থাৎ এই সময় সীমার মধ্যে নফল রোজা না রেখে রমজান মাসের ফরজ রোজার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করো।

 

তিনি আরও ইরশাদ করেন-

 

لا يَتَقَدَّ مَنْ أَحَدُكُمْ رَمَضَانَ بِصَوْمٍ يَوْمٍ وَلَا يَوْمَيْنِ إِلَّا أَنْ يَكُونَ رَجُلٌ كَانَ يَصُومُ صَوْمًا

 

فَلْيَصُمْ ذَلِكَ اليَوْمِ

 

অর্থ: তোমাদের কেউ যেন রমজানের একদিন বা দুইদিন আগে থেকে কোনো (নফল) রোজা না রাখে। তবে যে ব্যক্তি (সপ্তাহের বা মাসের) নির্দিষ্ট কোনো দিনে রোজা রাখতে অভ্যস্থ, সে (অভ্যস্থ দিন হিসাবে) ঐ দিনের রোজা রাখতে পারবে। (বায়হাকি শরিফ)

 

হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- শাবান আমার মাস আর রজব আল্লাহ পাকের মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস। শাবান মাস গুনাহকে দূরে রাখে এবং রমজান মাস গুনাহ পরিষ্কার করে। (গুনিয়াতুত্তালেবিন, পৃষ্ঠা ৪৪৬) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন যে, সাহাবায়ে কেরাম যখন শাবান মাসের চাঁদ দেখতেন, তখন বেশি থেকে বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং মুসলমানেরা গরিবদেরকে রমজানের রোজা রাখতে শক্তি যোগানোর জন্যে তাদের সম্পদের জাকাত বের করতেন। (গুনিয়াতুত্তালেবিন, পৃষ্ঠা ৪৪৭)

 

শবে বরাতের পরিচয়

 

আর এই শাবান মাসে এমন একটি রাত আছে, যে রাতকে ‘মুক্তির রাত’ বলা হয়। যাকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বরাত’ আর ফারসিতে ‘শবে বরাত’ বলে। এ রাতকে হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। আরবি ‘লাইলাতুন’ অর্থ রাত। ফারসি ‘শব’ অর্থও রাত। আর ‘বরাত’ শব্দের অর্থ মুক্তির নিষ্কৃতি। তাই লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত মানে মুক্তির রাত। অর্থাৎ এটি এমন একটি রাত, যে রাতে ইবাদত-বন্দেগী ও তাওবা-ইস্তিগফার কাছে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে পারলে, আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দিবেন।

 

শবে বরাতের ফজিলত

 

মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন-

 

حم * وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ *إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ * فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ * أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ * رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ

الْعَلِيمُ

 

অর্থ : হা-মিম। সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! নিশ্চয়ই আমি এই কুরআন নাজিল করেছি এক বরকতময় রাত্রিতে। আমি তো সকর্তকারী। আমার আদেশক্রমে এই রাত্রিতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়। আমি রাসুল প্রেরণ করে থাকি, আপনার রবের দয়াস্বরূপ। তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন। (সুরা দুখান, আয়াত ১-৬)

 

এই আয়াতে যে রাতটির কথা বলা হয়েছে, সেটা ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। এটি প্রখ্যাত তাবেয়ি মুফাসসির হযরত ইকরামা রহ. এবং মুফাসসিরিনে কেরামের এক জামাতের অভিমত। কিন্তু আল্লামা নববি রহ. এবং অধিকাংশ মুফাসসিরিনদের অভিমত হলো, উক্ত আয়াতে মুবারক রাত দ্বারা ‘লাইলাতুল কদর’ বুঝানো হয়েছে। কেননা কুরআন নাজিল সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন-

 

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ

 

অর্থ : নিশ্চয়ই আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। এখন এ দুটি মতামতের মধ্যে যে বিরোধ দেখা দিলো, তার কয়েকটি সমাধান দেয়া হয়েছে-

 

ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে লাইলাতুল কদর সারা বছর ঘুরে ঘুরে হয়, এটি রমজানের সাথে খাস নয়। তাই বর্ষপরিক্রমায় কোনো এক বছর ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা শবে বরাতও ‘লাইলাতুল কদর’ হতে পারে।

 

এ রাতে কুরআন নাজিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর সিদ্ধান্ত নেয়াটাকে অনেক ক্ষেত্রে কর্মসম্পাদন বলেও অভিহিত করা হয়। হয়। পরে সেখান থেকে শবে কদরে নুজুল শুরু হয় এবং ২৩ বছরে তা শেষ হয়। এভাবে কুরআনুল কারিমের নুজুল দুই রাতেই হতে পারে।

 

হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন- ‘সারা বছর যা কিছু হওয়ার থাকে, হায়াত, মওত, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদি সবকিছু শবে কদরে লাওহে মাহফুজ থেকে কপি করে নেওয়া হয়।’ সুতরাং পার্থক্য এই যে, শবে কদরে ফয়সাগুলো লাওহে মাহফুজ থেকে লিখে নেয়া হয়, আর শবে বরাতে ফেরেশতাদের কাছে দায়িত্ব পালনের জন্যে সোপর্দ করা হয়। শবে বরাতে প্রাপ্ত এই দায়িত্ব ফেরেশতাগণ সারা বছর ধরে কার্যকর করতে থাকেন। এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।

 

তাফসিরে রুহুল মাআনি, তাফসিরে জালালাইন, তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন, তাফসিরে বয়ানুল কুরআন, বায়হাকি শরিফ, ইবনে মাজাহ শরিফ ও মিশকাত শরিফে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’-এর ফজিলতের কথা উল্লেখ আছে। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আলি, হযরত আয়েশা, হযরত আবু হুরায়রাসহ (রাযি.) দশ জন সাহাবি থেকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’-এর ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনা আছে।

 

সুতরাং শবে বরাতের ফজিলতের বর্ণনাসূত্র যদিও কিছুটা দুর্বল হয়, তথাপি তা ফজিলত প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই এ রাতের কোনোই গুরুত্ব নেই- একথা বলা মোটেও ঠিক নয়। এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা মধ্যপন্থি উম্মত। এরা সবধরনের বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে উম্মতে ওসায়াত অর্থাৎ, মধ্যপন্থি উম্মত করেছি।

 

(সুরা বাকারা, আয়াত নং ১৪৩) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- সুসংবাদ দাও, ঘৃণা ছড়িও না। সহজ করো, কঠিন করো না। (বুখারি ও মুসলিম)

 

মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ইসলামের রীতি। সুতরাং শবে বরাত বলতে কিছুই নেই- এটাও যেমন ঠিক নয়, তেমনি শবে বরাতে মসজিদ আলোকসজ্জা করা, হালুয়া- রুটি তৈরি করে ঘরে ঘরে বিতরণ করা, আতশবাজি-পটকাবাজি করা ইত্যাদিও ঠিক নয়। বরং এ রাতের আমল হলো, প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্য অনুযায়ী একমনে একধ্যানে আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। কারণ এ রাত, মুক্তির রাত। মহানবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

 

إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوا لَيْلَهَا وَصُوْمُوا يَوْمَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا القَرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ إِلَّا مُسْتَغْفِرْ فَأَغْفِرَ لَهُ أَلَّا مُسْتَغْزِقَ فَأَرْزَقَهُ أَا مُبْتَلَ فَأُعَافِيْهِ أَلَّا كَذَا أَلَّا كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ

অর্থ : যখন শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত আসে, তখন তোমরা রাতে ইবাদত করো এবং পরের দিন রোজা রাখো। কারণ এই রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আকাশে এসে বলেন- আছো কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছো কি কোনো রিজিক প্রার্থণাকারী? আমি তাকে রিজিক দেবো। আছো কি কোনো মুছিবতে আক্রান্ত ব্যক্তি? আমি তাকে আরাম দান করবো? আছো কি কোনো এরূপ? এরূপ…? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ শরিফ)

হাদিস শরিফে আছে- অর্ধ শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের দিকে মনোযোগি হন এবং মাফ করে দেন। তবে মুশরিক ও হিংসুককে মাফ করেন না। অন্য একটি বর্ণনায় আছে, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে মাফ করেন না।

 

মুশরিককে মাফ না করার কারণ

 

মুশরিকরা আল্লাহ পাকের বিদ্রোহী। বিদ্রোহীরা যতই ভালো কাজ করুর, রাষ্ট্র তাদের ফাঁসি দিয়ে দেয়। তার কোনো কথাই শোনা হয় না। তেমনি মুশরিকরা আল্লাহর বিদ্রোহী হয়েছে। তারা আল্লাহর জগতে বাস করে; অথচ অন্যের উপাসনা করে। অন্যকে আল্লাহর গুণের সমান গুণী মনে করে। অন্যকে আল্লাহর মতো ক্ষমতাবান মনে করে। যেমন- কোনো মৃত ব্যক্তির মাজারে গিয়ে যদি কেউ মৃতকে সম্বোধন করে বলে, আমার রোগ ভালো করে দাও, অথবা আমাকে সন্তান দাও, অথবা ব্যবসায় উন্নতি দাও, তবে সে ব্যক্তি মুশরিক হবে। সে মৃত ব্যক্তিকে আল্লাহর মতো ক্ষমতাবান মনে করেছে। ফলে সে আল্লাহর বিদ্রোহী হয়ে পড়েছে। এখন আর আল্লাহ তাকে মাফ করবেন না।

 

হিংসা পোষণকারী

 

হিংসা বলা হয় অন্যের উন্নতি দেখে সহ্য না হওয়া। হিংসার কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। হিংসার প্রথম পর্যায় হলো, অপরের উন্নতি দেখে মনে মনে অস্বস্তি বোধ করা; কিন্তু মুখে তা প্রকাশিত না হওয়া। এই পর্যায়ের হিংসায় গুনাহ হয় না; তবে এরূপ মনোভাব ত্যাগ করা ভালো। কারণ এই মনোভাব একসময় প্রকাশ হয়ে গুনাহর রূপ নিতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ের হিংসা হলো, অপরের উন্নতিতে অস্বস্তি বোধ করা এবং সেটা প্রকাশিত করে তার উন্নতিতে বাধা দেওয়া অথবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা। এরূপ হিংসা করা হারাম।

 

হিংসুক ও খিযির আ.

 

এক ব্যক্তি প্রতিবেশীর উন্নতিতে হিংসা পোষণ করতো। তবে তার উন্নতিতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তবু মনে মনে ক্ষতি সাধন করার ফন্দি-ফিকির করতো। প্রতিবেশির গৃহ-সামগ্রী দেখে তার হিংসা হতো। সে মনে মনে ভাবতো, ওর একটা হলে আমার যদি দুইটা হতো তবে ভালো হতো, সে কোনোদিন আমার উপরে উঠতে পারতো না।

 

একদিন হযরত খিযির আ.-এর সঙ্গে তার দেখা হলো। সে খিযির আ.কে বললো- হুযুর, আমার জন্যে দোয়া করেন যেন প্রতিবেশী যা কিছু একটা পাবে, আমি যেন সেই জিনিস দুইটা পেয়ে যাই। হযরত খিযির আ. দোয়া করলেন যেন তাই হয়। দোয়া কবুল হলো। এরপর একদিন তার প্রতিবেশী একতলা দালান বানালো, সঙ্গে সঙ্গে তার দুইতলা দালান হয়ে গেলো। সে খুব খুশি হলো। মনে মনে ভাবলো খিযির আ.-এর দোয়া কবুল হয়েছে, আমার আর ভাবনা কিসের! একদিন প্রতিবেশীর একটা গাড়ি হলো, সঙ্গে সঙ্গে তার দুইটা গাড়ি হয়ে গেলো। প্রতিবেশীর এক বিঘা জমি হলে তার দুই বিঘা হয়ে যায়। এভাবে চলতে লাগলো। একদিন প্রতিবেশীর এক চোখ অন্ধ হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো। সে মহা বিপদে পড়ে গেলো।

খিযির আ. এসে হাজির হলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছো? প্রতিবেশীর চেয়ে দ্বিগুণ পেয়ে যাচ্ছো তো? সে বললো, আমি যে এখন দুই চোখের অন্ধ! এমনটা হবে তাতো আমি আগে জানতাম না! খিযির আ. বললেন, হিংসার পরিণাম এরকমই হয়। এখনো আরও বাকি আছে। সামনে আরও দেখতে পারবা। এই বলে খিযির আ. বিদায় হলেন। কিছুদিন পর দেখা গেলো প্রতিবেশীর একটি পা খোঁড়া হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার দুইটি পা খোঁড়া হয়ে গেলো। তারও কিছুদিন পর প্রতিবেশীর একটি হাত অবশ হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার দুইটি হাত অবশ হয়ে গেলো। এভাবে হিংসার ফল নির্মম তরবারির আঘাতের মতো একটির পর একটি তার জীবনের উপর পড়তে লাগলো। এরপরও পরকালের আজাব তো রয়েই গেছে। পরকালের আজাব আরো কঠিন।

 

পিতা-মাতার অবাধ্য

 

মানুষের অস্তিত্বের মাধ্যম হলো পিতা-মাতা। হাদিস শরিফে আছে-

 

مَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللَّهَ

অর্থ: যে ব্যক্তি মানুষের শোকর করতে পারে না, সে আল্লাহর শোকর করতে না।

 

পারে শ্রেষ্ঠ মানুষ হলো পিতা-মাতা। সুতরাং মানুষের শোকরের জন্যে শ্রেষ্ঠ স্থান আর শ্রোতা-মাতা। পিতা-মাতাকে যারা সন্তুষ্ট রাখে, তাদের দোয়া কবুল হয়, গুলোর গুনাহ মাফ হয়, তাদের দুনিয়াতে উন্নতি হয় এবং পরকালে নাজাত হয়। দুনিয়াতে উন্নতির একটি ঘটনা শুনুন-

 

ইরাকে এক ব্যক্তি বাস করতো। সে শুনতে পেলো যে সিরিয়ায় এক আশ্চর্য ব্যক্তি আছে। সে যে দোয়াই করে সেটা কবুল হয়ে যায়। অর্থাৎ সে ‘মুস্তাজাবুন দাওয়াত’। ফলে এত বড় বুজুর্গকে দেখার জন্যে লোকটির আগ্রহ হলো। কিন্তু দূরের সফর। যানবাহন নাই। তবু অনেক কষ্টে একটি উট সংগ্রহ করে তাকে দেখার জন্যে রওয়ানা হয়ে গেলো। অনেকদিন পর সে সিরিয়ায় উপস্থিত হলো। কিন্তু সেই বুজুগের বাড়ি সে চেনে না। অতঃপর খুঁজতে খুঁজতে দেখলো এক ব্যক্তি দুইটি শূকরকে সাবান দিয়ে অতি যত্ন সহকারে গোসল করাচ্ছে। সে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ভাই আপনাদের এই দেশে এক ব্যক্তি আছে সে ‘মুস্তাজাবুদ দাওয়াত’। বলতে পারেন সেই বুজুর্গের বাড়ি কোনটা? লোকটি বললো, আমিই সেই লোক। আমার সব দোয়াই আল্লাহ কবুল করেন। ইরাকি মুসাফিরটি অবাক হয়ে বললো, আপনি আবার কিসের বুজুর্গ? আপনি তো শূকরকে সাবান দিয়ে গোসল করাচ্ছেন। আপনাকে তো মুসলমান বলেই মনে হচ্ছে না। লোকটি বললো, আমি সত্যি কথা বলছি। আমিই সেই লোক। এই দেখুন আমি দোয়া করে আল্লাহর কাছে থেকে অনেক সম্পত্তি চেয়ে নিয়েছি। এখন আমার প্রয়োজনীয় সম্পদ জুটেছে। অন্ন-বস্ত্র সবই আল্লাহ দিয়েছেন।

আবার পরকালের সম্পদের জন্যে তাঁর ইবাদত বন্দেগীও নসিব হয়েছে। দুনিয়া ও পরকালের সম্পদে আমার জীবন ভরপুর হয়ে উঠেছে। ইরাকি লোকটি বললো, তবে শূকর পুষছেন কেন? আর শূকর দুইটিকে এত যত্ন করে গোসল করাচ্ছেন কেন? সে বললো, এগুলো শূকর নয়। এরা মানুষ। আমার বাপ-মা। একটি নিকৃষ্টি গুনাহর কারণে আল্লাহর গজবে পড়ে তারা শূকর হয়ে গেছে। এখন আমি আর কি করি? তাদের গুনাহর জন্যে তারা আল্লাহর সঙ্গে বুঝাপড়া করবে। কিন্তু আমি তো আর বাপ-মাকে ফেলে দিতে পারি না! তাই তাদেরকে পুষে যাচ্ছি এবং বাপ-মায়ের মতো করে খেদমত করে যাচ্ছি। এই খেদমতের বরকতে আল্লাহ তাআলা আমাকে ‘মুস্তাজাবুদ দাওয়াত’ করে দিয়েছেন। ইরাকি লোকটি বললো, তাহলে আপনি দোয়া করে শূকর দুইটিকে মানুষ বানিয়ে নিচ্ছেন না কেন? সে বললো, দেখুন, সৃষ্টির বিরুদ্ধে কোনো দোয়া চলে না। আকাশটা আল্লাহর সৃষ্টি। এখন আকাশকে মাটি আর মাটিকে আকাশ বানানোর জন্যে যদি দোয়া করি তবে সেটা তো সম্ভব নয়! দোয়া কবুল হওয়ার একটা সীমারেখা আছে। এই সীমার ভিতরে থেকে দোয়া করতে হবে। সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার দোয়া করা যায় না।

শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা
শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা

মাটিকে স্বর্ণে পরিণত করার দোয়া

 

এ প্রসঙ্গে শবে বরাতে দুই ব্যক্তির দোয়া করার একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। তারা সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার জন্যে দোয়া করেছিল। ঘটনাটি কানপুর জেলার। তারা শুনতে পেয়েছিল যে, শবে বরাতে আল্লাহ তাআলা রিজিকের ফয়সালা করে থাকেন এবং এই রাত্রিতে যা চাওয়া হয়, তাই পাওয়া যায়। সুতরাং দুজনে একটি মাটির ঢেলা নিয়ে নির্জনে এক মাঠের ধারে বসে গেলো। ঢেলাটি একটি রুমাল দিয়ে ঢেকে নিলো। তারপর দোয়া করতে লাগলো- হে আল্লাহ, আমরা গরিব মানুষ, এই ঢেলাটি যেন সোনা হয়ে যায়। শবে বরাতে তুমি দোয়া কবুল করে থাকো। সকাল যতই ঘনিয়ে আসছিল তাদের দোয়া জোড় ততই বেড়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন সকাল হলো, তখন রূমাল খুললো। কিন্তু একি! ঢেলাটির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই আসল ঢেলাটি অসহায়ের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সকল আশা-আকাঙ্খা শেষ হয়ে গেলো। মনটা ভেঙে গেলো এই ভেবে যে, শবে বরাত সারাটাই বৃথা গেছে! মনের মধ্যে নানা রকম শয়তানি খেয়াল ভিড় করতে লাগলো, শবে বরাতে দোয়া কবুল হয়, আজ শবে বরাত ছিল, কিন্তু কিছুই তো হলো না। তাহলে আলেমদের মুখে যা কিছু শুনেছিলাম সবই কি মিথ্যা?

 

এক দর্জি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। দুজনকে চিন্তাক্লিষ্ট বসে থাকতে দেখে কাছে এসে দাঁড়ালো। লোকটি আলেমদের ছোহবত পেয়েছিল, তাই তাদের ঈমান বরবাদ হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে ভাই? আপনারা এখানে এত চিন্তিত হয়ে বসে আছেন কেন? তখন তারা বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললো। এই শুনে লোকটি বললো, ভাই, আপনারা আল্লাহ পাকের শোকরিয়া আদায় করেন। এর পিছনে তাঁর অনেক হেকমত রয়েছে। তার মধ্যে একটি আমার বুঝে এসেছে। তা হলো এই যে, আল্লাহ আপনাদেরকে মুহাব্বত করেন। তাই আপনাদের জীবন রক্ষা করেছেন। তিনি যদি এই মাটির ঢেলাকে সোনা বানিয়ে দিতেন, তবে তার ভাগাভাগি নিয়ে এখনই ঝগড়া সৃষ্টি হয়ে যেতো। এরপর শুরু হতো মারামারি। তারপর মাথা ফাটতো এবং অবশেষে একজন নিহত হতো, অপর জনের বিচারে ফাঁসি হতো। ফলে দুই জনেরই মৃত্যু হতো এবং সোনার পিণ্ড তার জায়গায় পড়ে থাকতো। সুতরাং আল্লাহ পাক আপনাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এই কথা শুনে লোক দুইটি খুব খুশি হলো এবং আল্লাহর শোকরগুজারি করলো। সুতরাং হক্কানি আলেমের ছোহবত পেলে যেমন নিজের ঈমান রক্ষা হয় তেমনি অন্যের ঈমান রক্ষা করতে সাহায্য করা যায়।

 

সুতরাং আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার দোয়া করা চলে না। পিতা-মাতাকে সর্বাবস্থায় খেদমত করে যেতে হবে। বাপ-মা যদি কোনো কারণে শত্রুতাও করে তবে তাদেরকে মাজুর মনে করতে হবে। হয়তো কোনো মানসিক অসুস্থতার তারণে সেরূপ করছে। কাছে থাকলে যদি বাপ-মায়ের সহ্য না হয়, তবে দূরে সরে থেকে তাদের হেদায়েত ও শান্তির জন্যে দোয়া করতে হবে। এসব কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা। এই শিক্ষা অনুযায়ী আমল না করলে আল্লাহ তাকে মাফ করেন না। তাছাড়া মা-বাপ হলো মূল আত্মীয়। এই আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করলেও দোয়া কবুল হয় না এবং শবে বরাতে মাফ পাওয়া যায় না।

 

মোটকথা, কেউ যদি তোমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, তবে তুমি ছিন্ন করো না। কাছে গেলে সে যদি বিরক্ত হয় তবে দূরে থেকে তার জন্যে দোয়া করো এবং মাঝেমধ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী (একটি মেসওয়াক হলেও) হাদিয়া পাঠাও। তাহলে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী হিসাবে গণ্য হবে না এবং তোমার দোয়া কবুল হবে।

 

তাওবা কবুল হওয়ার চারটি শর্ত

 

শবে বরাত হলো গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার রাত। গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে খাঁটি মনে তাওবা করা জরুরি। তাওবা কবুল হওয়ার চারটি শর্ত আছে-

 

প্রথম: অতীতে যত গুনাহ হয়ে গেছে, তার জন্যে মনে মনে অনুতাপ করতে হবে যে, সত্যিই আমি অন্যায় করে ফেলেছি, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। যদি আমার মাফ না হয় তাহলে আমার কঠিন শাস্তি হবে। সেই শাস্তি আমি সহ্য করতে পারবো না। এভাবে মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে। গুনাহর জন্যে অনুতপ্ত না হয়ে শুধু মুখে মুখে ‘আল্লাহ মাফ কর দাও’ বললে গুনাহমাফ হবে না।

দ্বিতীয়: যে গুনাহ থেকে তওবা করবে, সে গুনাহ এখনই ছেড়ে দিতে হবে। গুনাহ জারি রেখে মুখে মুখে শতবার মাফ চাইলেও গুনাহ মাফ হবে না।

 

তৃতীয়: আল্লাহর কাছে এরূপ পাক্কা ওয়াদা করতে হবে যে, আগামীতে আর কখনও ঐ গুনাহ করবো না।

 

চতুর্থ: গুনাহটি যদি কোনো বান্দার হক নষ্ট করার কারণে হয়ে থাকে, তবে সেই বান্দার কাছ থেকে মাফ করিয়ে আল্লাহর কাছ থেকেও মাফ করাতে হবে। বান্দা যদি মাফ না করে, তবে আল্লাহ মাফ করবেন না।  বান্দার হক নষ্ট করা মানে বান্দার কোনোরকম ক্ষতি করা। যেমন, টাকা-পয়সা নিয়ে নেয়া, জমি দখল করে নেয়া, ঘুস ও সুদ নেয়া ইত্যাদি। এগুলো ফেরত দিয়ে তার কাছ থেকে মাফ করাতে হবে এবং আল্লাহর কাছ থেকেও মাফ করাতে হবে। যদি মালিক মারা গিয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদেরকে ফেরত দিতে হবে। ওয়ারিশও যদি না পাওয়া যায়, তবে আল্লাহর রাস্তায় সেগুলো দান করে দিয়ে মালিকের নামে সাওয়াব বখশিয়ে দিবে, হয়তো সে সাওয়াব পেয়ে খুশি হয়ে কেয়ামতের দিন মাফ করে দিবে। আবার কারো গিবত করা, কাউকে মারধর করা, কারো মনে কষ্ট দেয়া ইত্যাদির জন্যে কিছু ফেরত দিতে হবে না; শুধু তাকে সন্তুষ্ট করে মাফ করিয়ে নিতে হবে।

 

শবে বরাতের আমল

 

এ রাতে তিন প্রকার আমলের কথা হাদিসে পাওয়া যায়। প্রথম হলো: ১৪ শাবান দিবাগত রাত জাগরণ করে ইবাদত করা। তাওবা করে গুনাহমুক্ত হওয়া।

দ্বিতীয় হলো: পরের দিন ১৫ শাবান রোজা রাখা।

তৃতীয় হলো: একাকী কবর জিয়ারত করা। হযরত আয়েশা রা. বলেন- সেরাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমার ঘরে রাত্রি যাপন করার পালা ছিল। অর্ধেক রাতের পর তিনি শোয়া থেকে উঠলেন। চাদর গায়ে দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর চাদরের আঁচলটি আমার পিঠের নিচে পড়েছে। আমার ঘুম ভেঙে যাবে মনে করে তিনি চাদরটি রেখেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার যেন ঘুম না ভাঙে সেজন্যে আস্তে করে জুতা পায়ে দিলেন, আস্তে করে দরজা খুললেন এবং আস্তে করে বাইরে গেলেন। আমি সবই দেখছিলাম। এবার আমি উঠলাম। দূরত্ব বজায় রেখে তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলাম। দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, তিনি ‘জান্নাতুল বাকি’ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দোয়া করেছেন। দোয়া শেষ করে পিছনের দিকে ফিরতে যাবেন, তার আগেই আমি দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিনি ঘরে এসে মুনাজাত করে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখন হাঁপাচ্ছিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে আয়েশা! তুমি ওমন হাঁপাচ্ছো কেন? আমি তখন সব ঘটনা খুলে বললাম।

 

তিনি বললেন, তুমি কি মনে করো আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল তোমার উপর অবিচার করবেন? অর্থাৎ তোমার পালার রাত্রিতে তোমার হক নষ্ট করে আল্লাহর রাসুল কি অন্য বিবির ঘরে যাবেন? অতঃপর তিনি বললেন, আজকের রাত কিসের রাত জানো আয়েশা? আজ শাবান মাসের পনেরো তম রাত। আল্লাহ তাআলা এই

রাতে দুনিয়ার আকাশে তাজাল্লি করেন এবং সবাইকে মাফ করে দেন। তুমি কি অনুমতি দিবা যে এই রাতে আমি আরও এবাদত করি? তখন হযরত আয়েশা রাযি, খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন। অন্যের জন্যে দোয়া করলে ফেরেশতাগণ তার জন্যে দোয়া করেন। নিজের জন্যে দোয়া করলে তার দোয়া কবুল না-ও হতে পারে। কিন্তু ফেরেশতার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। এ জন্যে অন্যের জন্যে দোয়া পারে অনেক বরকতের বিষয়। আর টাকা পয়সা যেমন দান করা যায়, তেমনি করায়াব দান করা যায়। সুতরাং সাওয়াব উপার্জন করে মৃত ব্যক্তিকে দান ওমানি সাওয়াব নিজের সাওয়াব অটুট থাকে। আবার সেই দানেরও সাওয়াব পাওয়া যায়। আরও সুবিধা এই যে, মৃত ব্যক্তির যদি কোনো হক নষ্ট করে থাকো, তবে তোমার সাওয়াব দান করার ফলে সে খুশি হয়ে পরকালে তোমাকে তার হক মাফ করে দিতে পারে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে শবে বরাত শুরু হয়ে যায় এবং সুবহে সাদেক পর্যন্ত বহাল থাকে। এ রাতে ইবাদতের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সারা রাত জাগ্রত থাকতে হবে- এমনও বিধান নেই। আপনাদের সুবিধার জন্য এখানে ইবাদতের একটি নমুনা তুলে ধরলাম। ইচ্ছা হলে এভাবে ইবাদত করতে পারেন- সময়-সুযোগ থাকলে ইবাদতের প্রস্তুতিস্বরূপ সূর্য ডোবার আগে গোসল করা ভালো। গোসল করলে দেহ-মন পবিত্র হয়ে ইবাদতে আগ্রহ ও উৎসাহ জন্মে। তারপর মাগরিবের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবেন। তারপর একা একা এশার নামাজ পর্যন্ত জিকিরে লিপ্ত থাকবেন। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (মাঝে মাঝে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ পড়ে নিবেন) আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ, আস্তাগফিরুল্লাহ- এই ছয়টি কালেমা সম্ভব হলে এক হাজার বার করে পড়বেন, অথবা নিজের সুবিধামতো সংখ্যা পড়বেন। কুরআন তেলাওয়াত করবেন। তারপর যদি এশার নামাজের দেরি থাকে তবে ‘আল্লাহু’ জিকির করতে থাকবেন এবং জিকিরের শেষে নিজের হেদায়াতের পথে বহাল থাকার জন্যে একা একা দোয়া করবেন। তারপর জামাতে এশার নামাজ আদায়ের পর, এদেশের প্রায় প্রতিটি মসজিদে বরাতের রাতে বয়ান হয়, সেই বয়ান শুনবেন। বয়ান শোনার পর একাকী নফল নামাজ পড়বেন। এ নামাজের আলাদা কোনো নিয়ম কিংবা নির্দিষ্ট কোনো রাকাত সংখ্যা নেই। স্বাভাবিক নফল নামাজের মতো পড়বেন। কুরআন তেলাওয়াত করবেন। যদি কারো ফরজ নামাজ কাযা থাকে, তবে সে নফল না পড়ে কাযা নামাজ আদায় করবেন।

উমরী কাযার নিয়ম

মহিলার ক্ষেত্রে যেদিন তার জীবনের প্রথম হায়েজ হয়েছে, সেদিন থেকে মে বালেগ হয়েছে। পুরুষ লোকের যে মুহূর্তে বীর্যপাত হয়েছে, পেমুহূর্ত থেকে সে বালেগ হয়েছে। আর যদি অনেক বয়স হওয়ার পরও হায়েজ বা বীর্যপাত না হয়, তবে যে মুহূর্তে তার চান্দ্র বছরের (হিজরি) হিসাবে পনেরো বছর অথবা সৌর বছর (বাংলা, ইংরেজি) হিসাবে চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয়েছে, সেদিন থেকে সে বালেগ হয়েছে। এই বালেগ হওয়ার মুহূর্তের পর থেকে যেদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়া শুরু করেছে, সেদিন পর্যন্ত কত ওয়াক্ত নামাজ ছুটে গেছে সেটা হিসাব করতে হবে। হিসাবের সময় দেখা গেলো, কিছুদিন এমন আছে, যেদিনগুলোতে মাঝে মাঝে নামাজ পড়া হয়েছে এবং মাঝে মাঝে ছুটে গেছে। তাহলে সেগুলো অনুমান করে একটা গড়-পড়তা হিসাব করতে হবে। দেখা গেলো কারো দশ বছরের নামাজ ছুটে গেছে। এবার প্রতিদিন বেতেরসহ ছয় ওয়াক্ত নামাজের কাযা করতে হবে। ৩৬৫ দিন এক বছর হয়। সুতরাং ৩৬৫টি ফজরের দুই রাকাত শুধু ফরজ নামাজ কাযার নিয়তে পড়তে হবে। তারপর ৩৬৫টি যোহরের শুধু চার রাকাত ফরজ নামাজ ৩৬৫ বার পড়তে হবে। এভাবে শুধু ফরজ নামাজগুলো এবং বেতেরের ওয়াজিব ৩৬৫ বার করে পড়লে এক বছরের নামাজ পড়া হয়ে যাবে। তারপর বাকি নয় বছরের নামাজ একইভাবে পড়ে যেতে হবে। এইভাবে পড়তে পড়তে একদিন জীবনের সমস্ত নামাজ কাযা পড়া হয়ে যাবে। ফলে সে পূর্ণ জীবনে নামাজি হয়ে যাবে এবং তার জীবনের দুনিয়াবী কাজ, পরিশ্রম ও দুঃখ-কষ্টও ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে।

নিয়ত করার সময় এভাবে করবেন- আমার জীবনে যতগুলো ফজর নামাজ কাযা আছে, তার প্রথমটা পড়ছি। প্রত্যেকবার একভাবেই নিয়ত করবেন। অন্যান্য ওয়াক্তের কাযা আদায়ের সময় ‘ফজর’-এর স্থানে ওই নামাজের নাম বলবেন, যে নামাজ কাযা করতে চান।

এরপর একা একা দোয়া করবেন। দোয়া করতে করতে ফজরের আজান হয়ে যাবে। ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবেন। মনে রাখবেন, যদি সারা রাত জাগার মধ্যে কোনোরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, তবে এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করলে সারা রাত ইবাদত করার সাওয়াব পাওয়া যায়। ইবাদত করতে করতে যদি ঘুমের বেগ বেশি হয় যে, ইবাদত কষ্টকর হয়ে পড়ে, তবে খানিকটা ঘুমিয়ে, পরে আবার অজু করে ইবাদত শুরু করলে ঘুমের সময়টাও ইবাদতের সাথে যোগ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে বুঝার এবং আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন!

শেষ কথা

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *