সাহাবায়ে কেরামগণ কি সত্যের মাপকাঠি?
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ ৷ কেমন আছেন? আশা করি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। প্রিয় পাঠক! আজকে এই পোস্টে জানতে পারবেন, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি বা সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি কি না। বাংলাদেশে অনেকে সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি মানতে রাজি নয়, আবার অনেকে সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি মানেন। এই দুই দলের কে সঠিক বা কে সঠিক নয়। তা আজকের পোস্টে জানতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ!
আরও পড়ুনঃ ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
সাহাবায়ে কেরামগণ কি সত্যের মাপকাঠি?
সাহাবী কারা বা সাহাবীদের পরিচয়?
সাহাবি অর্থ হলো সাথী, সহচর, সঙ্গী, পথ চলার সাথী ইত্যাদি। সাহাবীদের পরিচয় দিতে গিয়ে ইমাম বুখারী রাহঃ বলেন, যাঁরা রাসূল সা. এর উপর ঈমান এনেছেন এবং সোহবত লাভ করেছেন ও ঈমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদেরকে সাহাবী বলে।
সাহাবীদের পরিচয় দিতে গিয়ে আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী রঃ বলেন, ওই ব্যাক্তিকে সাহাবী বলে, যে রাসূল সাঃ এর উপর ঈমান এনে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং মুসলিম হয়ে ইন্তেকাল করেছেন।
সাহাবায়ে কেরামগণ কি সত্যের মাপকাঠি?
‘মি’য়ারে হক্ক’ তথা সত্যের মাপকাঠি একটি নতুন পরিভাষা। ইসলামের সোনালী যুগে এ পরিভাষাটির ব্যবহার পাওয়া যায় না। পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম প্রকৃত সত্য অনুধাবনের জন্য যে ব্যক্তি বা বস্তুকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, তাকে বুঝাতে এ পরিভাষাটিকে ব্যবহার করেছেন।
প্রথমেই জানা দরকার- হক্ব বা সত্য কী? তারপর জানা যাবে ঐ হক্ক বুঝার বা চেনার মাপকাঠি কোনটি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজ সত্ত্বা, তাঁর প্রেরিত অহি ও ইসলামকে হক্ক মর্মে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহই হলেন একমাত্র হক্ক। আর তাঁর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে তা বাতিল’। [সূরা হাজ্জ, ২২:৬২] ‘আর আমি কিতাব থেকে যে অহি আপানার নিকট প্রেরণ করেছি, তা-ই হক্ব, এটা তার পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী।’ [সূরা ফাতির : ৩৫:৩১]
সহীহ বুখারিতে এসেছে, আয়েশা রা. বর্ণনা করেন ‘অতঃপর একপর্যায়ে তাঁর নিকট হক্ক আগমন করেছে। আর তখন তিনি ছিলেন হেরা গুহায়।’ [বুখারী, আস সহীহ হা-৩] এ হাদীসে মা আয়েশা রা. হক্ক বলতে অহিকেই উদ্দেশ করেছেন। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ইসলামকেও হক্ক মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, বলুন! হক্ক এসেছে আর বাতিল দূরীভূত হয়েছে, বাতিল তো দূরীভূত হওয়ারই ছিল। [সূরা ইসরা : ১৭:৮১]
উল্লেখিত দলীলসমূহে যে ‘হক’-এর আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে, বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. হলেন সে ‘হক’-এর একমাত্রনির্ভুল প্রচারক। কোনটি হজ্ব, কোনটি বাতিল তা উম্মতকে তিনিই জানাবেন এবং তিনিই শিখাবেন। হজ্ব ও বাতিল বুঝার জন্য উম্মত তাঁর কাছেই ধর্না দেবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, আমি আপনার প্রতি এজন্যই কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি তাদের জন্য ব্যাখ্যা করে দেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করেছে।’ [সূরা নহল: ১৬:৬৪]
অহির নির্ভুল ব্যাখ্যা করা ও মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ের যথাযথ সমাধান দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী মুহাম্মদ সা.-এর উপরই ন্যস্ত করেছেন। তাই কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষ প্রকৃত সত্যের সন্ধানে তাঁর দিকেই ছুটে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হৈ ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের দায়িত্বশীলদের। তারপর যদি কোনো বিষয়ে তোমরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তাহলে তা আল্লাহ (কুরআন) ও তাঁর রাসূলের (হাদীস) দিকে ন্যস্ত কর। ‘[সূরা নিসা: ৪:৫৯]
উপরোক্ত আয়াতের নির্দেশনার অধীনে সাহাবাগণ রা. থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষ অন্তর্ভুক্ত। তাই তো সাহাবাগণ রা. কোনো বিষয়ে পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে পড়লে সমাধানের জন্য রাসূল সা.-এর নিকট গমন করতেন। রাসূল সা. উক্ত বিষয়ের সমাধান দেয়ার পর তারা বিনা দ্বিধায় তা মেনে নিতেন, এ বিষয়ে সামান্যও দ্বিমত করতেন না। উপরন্তু রাসূল সা.-এর সাথে কোনো বিষয়ে দ্বিমত করার অধিকারও কারো নেই। কিন্তু তারা নিজেরা বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পর দ্বিমত করতেন। তাদের পারস্পরিক দ্বিমত করার ঘটনা রয়েছে শত শত। সাহাবাগণের পারস্পরিক এ মতভেদই প্রমাণ করে যে, তারা একে অপরকে সত্যের মাপকাঠি মনে করতেন না।
রাসূল সা.-এর লক্ষাধিক সাহাবার মধ্যে কোনো সাহাবী নিজেকে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের মানদণ্ড, বা নিরঙ্কুশ আনুগত্য পাবার অধিকারী মনে করতেন এমন একজন সাহাবীও পাওয়া যাবে না। বরং তাদের কেউ কোন ভুল করলে অন্য কেউ ভুলের সংশোধনী দিলে তা তারা নির্দ্বিধায় মেনে নিতেন। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে হাবীব রা. বর্ণনা করেন, একদা ওমর রা. বললেন, তোমরা নারীদের মোহরানা নিয়ে অতিরঞ্জন করো না। অর্থাৎ বেশি পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করো না। তখন একজন মহিলা বলে উঠলেন হে ওমর! আল্লাহ বলেছেন, তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে কিনতার পরিমাণ মোহর প্রদান করতে পারো। তখনই ওমর রা. বললেন, মহিলা ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।[ইবনুল হাজর, ফাতহুল বারী, খ-৯]
বনু তামীম গোত্রের সর্দার নির্ধারণে রাসূল সা.-এর সম্মুখে আবু বকর সিদ্দিক রা. ও ওমর রা. পরস্পর শক্ত মতভেদে লিপ্ত হয়েছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা হুজুরাতের প্রথম কয়েকটি আয়াত নাজিল হয়েছে।
ওসমান রা.-এর সম্পদের ব্যাপারে আবুযর গিফারী রা.-এর সমালোচনা করা, আলী রা.- এর সাথে মুয়াবিয়া রা.-এর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়া সর্বজনবিদিত ঘটনা। এ সকল ঘটনা প্রমাণ করে সাহাবাগণ রা. একে অপরকে ভুলের উপর মনে করতেন না। তাই তারা প্রয়োজনে একে অপরের উন্মুক্ত সমালোচনা করতেন এবং ভুল করলে বিনাদ্বিধায় সংশোধনও করে দিতেন। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো সাহাবাগণ রা. সত্যের মাপকাঠি এমন নতুন আক্বীদা তৈরি করল কে? এবং নতুন উদ্ভাবিত এ আক্বীদার গ্রহণযোগ্যতাই কী?
সাহাবায়ে কেরাম রা.কে সত্যের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হলে নিচের প্রশ্নগুলোর সমাধান কী হবে?
১। ‘তোমরা পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে পড়লে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ন্যস্ত করো।’ -সূরা নিসার ৬নং আয়াতের নির্দেশ লঙ্ঘন করা হবে কিনা?
২। রাসূল সা. সত্যের মাপকাঠি এবং সাহাবাগণও সত্যের মাপকাঠি, তাহলে সত্যেরমাপকাঠির সংখ্যা মোট কত? নিশ্চয় লাখের উপরে। আর তখন রাসূল সা. ও সাহাবাগণকে একই মর্যাদায় সমাসীন করা হয় কিনা?
৩ ৷ সাহাবাগণ তো উম্মতেরই অন্তর্ভুক্ত। আর উম্মত সত্যের মাপকাঠি হলে নবীর আগমনের প্রয়োজন কী?
৪ ৷ কোনো সাহাবীর কথা ও কাজ যদি রাসূল সা.-এর কথা ও কাজের বিপরীত হয়, তাহলে কার কথা ও কাজ প্রাধান্য পাবে? নিশ্চয়ই রাসূল সা.-এর কথা ও কাজ। তাহলে মিয়ারে হক্ক কে হলো?
৫ ৷ অনুরূপভাবে সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যন্ত যে সাহাবগণ রা. থেকে কখনো কখনো ইচ্ছাকৃত কিছু ভুলত্রুটি ও গুনাহ প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোর ব্যাপারে কী বলা হবে? তারা কি সে ব্যাপারগুলোতেও সত্যের মাপকাঠি থাকবেন?
যেমন- উসামা বিন যায়েদ রা. একটি কাফেলার নেতৃত্বে থাকাকালীন একজন কালেমা পড়ুয়া ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন। এতে রাসূল সা. রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন, তুমি কেন তার কলব ছিড়ে দেখনি? সে সত্যিকার অর্থে কালেমা পড়েছিল কিনা? [আলবানী, সহীহুল জামি, হা-২৬৫৪]
আলী রা.-এর নিকট একদল মুরতাদকে উপস্থিত করা হলে তিনি তাদেরকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেন। এ সংবাদ শুনে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, যদি আমি হতাম, তাহলে তাদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম না। কেননা, রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা আল্লাহর শান্তি দ্বারা কাউকে শাস্তি দিও না।[বুখারী, আস সহীহ হা-৬৯২২]
সত্যের মাপকাঠি শুধু রাসূল সা.
উল্লেখিত আলোচনার আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ‘মি’য়ারে হক্ক’ তথা সত্যের মাপকাঠি হওয়া শুধু রাসূল সা.-এর জন্য নির্ধারিত। কেননা তিনি অহি দ্বারা পরিচালিত এবং নির্ভুল ও নিষ্পাপ। এ মহাসম্মানে তিনি একক ও অনন্য। তবে সাহাবায়ে কেরাম রা. উম্মতের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। কেননা তারা তাদের জীবন ও কর্মে রাসূল সা.কে কদমে কদমে অনুসরণ করেছেন। তাই তো আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সাহাবায়ে কেরাম রা. এর ওপর তাঁর সন্তুষ্টির কথা বর্ণনা করেছেন। তাদের মতো করে ঈমান গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের বিভিন্ন আমল ও ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রশংসা করেছেন। তাদের প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং অনুসরণ কর খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাহ।’ [তিরমিযী, আস সুনান, হা-২৬৭৬]
অন্য একটি হাদীসে এসেছে, রাসূল সা.কে প্রশ্ন করা হয়েছিল জান্নাতি দল কোনটি? তিনি বলেছেন, ‘আমি ও আমার সাহাবীগণ যে পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছি।'[তাবারানী, আল মু’জামুল আউসাত, হা-৪৮৮৬]
সাহাবায়ে কিরাম হকের মাপকাঠি
উল্লেখ্য যে, কোনো সাহাবীর কোনো কথা ও কাজ যদি কুরআন ও সুন্নাহর সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি করে [আবুযর গিফারী রা, সম্পদ জমা করাকে হারাম মনে করতেন।] তাহলে এ ক্ষেত্রে তার কথা ও কাজের অনুসরণ করা যাবে না। বরং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। আর যদি কোনো বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের সরাসরি নির্দেশনা পাওয়া না যায়, তাহলে ঐ বিষয়ে যেকোনো সাহাবীর কথা ও কাজকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হবে। কারণ তারা এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তারা দ্বীনের ব্যাপারে আদিল বা ন্যায়পরায়ণ এবং সত্যের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। [আদালতে সাহাবা ও মিয়ারে হক্ক দুটো বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। এ দুটো বিষয়কে একাকার করে ফেলার কারণে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়]
শেষ কথা
সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷