শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

সন্তানের নাম রাখা ও আকিকা ও ভালো নাম রাখার নির্দেশ ৷ শিশু সন্তান-সন্ততির নাম রাখার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ কি? শিশুর নাম রাখার ব্যাপারে ইসলাম দিক নির্দেশনা দিয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুন্দর ও পবিত্রতম নামের অধিকারী। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘তোমরা ইসলাম গ্রহণের পরে সুন্দর নাম রাখো। সুন্দর অর্থবোধক ও শ্রুতি মধুর নাম রাখতে হবে। যে নামের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর দাসত্ব প্রকাশ পায়, সেই ধরনের নাম আল্লাহর রাসূল অধিক পছন্দ করেছেন।

আরও পড়ুনঃ ইন্টারভিউ দেয়ার কৌশল

একজনের নাম ছিলো আব্দুল হাজার, এর অর্থ হলো পাথরের পিতা। আল্লাহর রাসূল সে নাম পরিবর্তন করে আব্দুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর গোলাম রেখে দিলেন। হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘আল্লাহর কাছে চূড়ান্ত খারাপ ও ক্রোধ উদ্রেককারী নাম হলো কোনো ব্যক্তিকে মালিকুল আমলাক নামে ডাকা।’ মালিকুল আমলাক শব্দের অর্থ হলো বাদশাহদের বাদশাহ। ফারসীতে এই নামের অর্থ হলো শাহানশাহ্ । সুতরাং শাহানশাহ হলেন একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এই নাম রাখা জায়েজ নেই। নবী-রাসূলের নামে সন্তানের নাম রাখতে হবে বা অন্য কোনো অর্থবোধক সুন্দর নাম রাখতে হবে।

শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

এমন নাম রাখতে হবে যা শুনে যেনো বোঝা যায় লোকটি মুসলমান। এমন নাম রাখা যাবে না, যার ভেতর দিয়ে শির্কমূলক ভাবধারা প্রকাশ পায় বা কোনো বস্তুর দাসত্ব প্রকাশ পায়। আল্লাহ তা’য়ালার অনেক গুণবাচক নাম রয়েছে। যেমন আজীজ, হালিম, সাত্তার, আলিম, রাব্ব ইত্যাদি। এসব নামের পূর্বে আবদ যোগ করে নাম রাখা যায়। যেমন আব্দুল আজীজ অর্থাৎ আজীজের গোলাম। আল্লাহর গুণবাচক নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যাদের নাম রাখা হয়েছে, তাদেরকে শুধুমাত্র হালীম, আলিম বা আজীজ বলে ডাকা যাবে না-পূর্ণ নাম ধরেই ডাকতে হবে।

নাম বিকৃত করে ডাকা

রশীদকে রইশ্যা, খলীলকে খলীল্যা, আমীনকে আমীন্যা বলে অর্থাৎ মূল নামকে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে অনেক স্থানেই ডাকতে বা সম্বোধন করতে দেখা যায়। প্রশ্ন হলো, এভাবে নাম বিকৃত করে ডাকা ইসলামী শরীয়তে জায়েজ কিনা?

নাম বিকৃত করে কাউকে ডাকা শরীয়তে হারাম করা হয়েছে। এভাবে কাউকে ডাকা যাবে না। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ একজন আরেকজনকে খারাপ উপনামে ডাকবে না। (সূরা হুজুরাত-১১)

রাব্বি নাম রাখা যাবে কি?

রাব্বি নাম রাখা শরীয়তে জায়েয আছে কি? রব হলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং আরবী রব শব্দ থেকেই রাব্বি শব্দ এসেছে। সরাসরি কোনো মানুষকে এই নামে ডাকা জায়েয নেই। আব্দুর রব নাম রাখা যেতে পারে। যার অর্থ হলো, রব-এর গোলাম।

নাম রাখার সময়

সপ্তম দিন নাম রাখা ভালো। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘জন্মের সপ্তম দিন নবজাতকের নাম রাখো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৩২)

আগে-পরে হলেও কোনো ক্ষতি নেই। জন্মের আগেও নাম নির্ধারণে বাধা নেই। (আবু দাউদ : ২/৪৪৬)

নাম পরিবর্তন করা

অনেকে নাম পরিবর্তন করে থাকে। প্রশ্ন হলো, নাম পরিবর্তন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ আছে কি?

পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো পিতামাতা তার একটি সুন্দর অর্থবহ নাম রাখবেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সুন্দর অর্থবহ নাম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর কাছে সন্তানের নাম রাখার আবেদন করলে তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখতেন। কারো নাম আল্লাহর রাসূলের পছন্দ না হলে তিনি সেই ব্যক্তির ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পণ করতেন না।

আবার কারো সুন্দর ও অর্থবহ নাম শুনলে তিনি খুশী হয়ে তার জন্য দোয়া করতেন। নাম অপছন্দ হলে সে নাম তিনি পরিবর্তন করে উত্তম নাম দিতেন। সুন্দর ও অর্থবহ নাম বলতে ঐ সমস্ত নামসমূহ বুঝায়, যে নামের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর দাসত্ব বা প্রশংসা প্রকাশ পায়। বর্তমানে অর্থহীন আজেবাজে নাম রাখা একটি ঘৃণ্য প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নাম পরিবর্তন করে ঐসব নামই নির্বাচন করতে হবে, যে নামের মধ্য দিয়ে এ কথা প্রকাশ পায় যে, মানুষটি মহান আল্লাহর গোলাম।

কোন নাম রাখা যাবে না

নাম রাখা ইসলামের অন্যতম বিধান। তবে কাফের মুশরিক এবং কুখ্যাত পাপীদের নামানুসারে নাম রাখা হারাম।

  • এক. আল্লাহর নাম নয় এমন কোনো নামের সাথে গোলাম বা আব্দ (বান্দা) শব্দটিকে সম্বন্ধ করে নাম রাখা হারাম।যেমন- আব্দুল ওজ্জা (ওজ্জার উপাসক), আব্দুশ শামস (সূর্যের উপাসক), আব্দুল কামার (চন্দ্রের উপাসক), আব্দুল মোত্তালিব (মোত্তালিবের দাস), আব্দুল কালাম (কথার দাস), আব্দুল কাবা (কাবাগৃহের দাস), আব্দুন নবী (নবীর দাস), গোলাম রসূল (রসূলের দাস), গোলাম নবী (নবীর দাস), আব্দুস শামছ (সূর্যের দাস), আব্দুল কামার (চন্দ্রের দাস), আব্দুল আলী (আলীর দাস), আব্দুল হুসাইন (হোসাইনের দাস), আব্দুল আমীর (গর্ভনরের দাস), গোলাম মুহাম্মদ (মুহাম্মদের দাস), গোলাম আবদুল কাদের (আবদুল কাদেরের দাস) গোলাম মহিউদ্দীন (মহিউদ্দীন এর দাস) ইত্যাদি।

 

  • তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় নামের মধ্যে ‘আব্দ’ শব্দটা থাকলেও ডাকার সময় ‘আব্দ’ শব্দটা ছাড়া ব্যক্তিকে ডাকা হয়। যেমন আব্দুর রহমানকে ডাকা হয় রহমান বলে। আব্দুর রহীমকে ডাকা হয় রহীম বলে। এটি অনুচিত। আর যদি দ্বৈত শব্দে গঠিত নাম ডাকা ভাষাভাষীদের কাছে কষ্টকর ঠেকে সেক্ষেত্রে অন্য নাম নির্বাচন করাটাই শ্রেয়। এমনকি অনেক সময় আল্লাহর নামকে বিকৃত করে ডাকার প্রবণতাও দেখা যায়। এ বিকৃতির উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহকে হেয় করা তাহলে ব্যক্তির ঈমান থাকবে না। আর এই উদ্দেশ্য না থাকলেও এটি করা অনুচিত।

 

  • দুই: অনুরূপভাবে যেসব নামকে কেউ কেউ আল্লাহর নাম মনে করে ভুল করেন অথচ সেগুলো আল্লাহর নাম নয় সেসব নামের সাথে আব্দ বা দাস শব্দকে সম্বন্ধিত করে নাম রাখাও হারাম ৷ যেমন- আব্দুল মাবুদ (মাবুদ শব্দটি আল্লহর নাম হিসেবে কুরআন ও হাদীছে আসেনি; বরং আল্লাহর বিশেষণ হিসেবে এসেছে), আব্দুল মাওজুদ (মাওজুদ শব্দটি আল্লহর নাম হিসেবে কুরআন ও হাদীছে আসেনি)

 

  • তিন: মানুষ যে উপাধির উপযুক্ত নয় অথবা যে নামের মধ্যে মিথ্যাচার রয়েছে অথবা অসার দাবী রয়েছে এমন নাম রাখা হারাম। যেমন- শাহেনশাহ (জগতের বাদশাহ) বা মালিকুল মুলক (রাজাধিরাজ) নাম বা উপাধি হিসেবে নির্বাচন করা।সাইয়্যেদুন নাস (মানবজাতির নেতা) নাম রাখা। একই অর্থবোধক হওয়ার কারণে মহারাজ নাম রাখাকেও হারাম বলা হয়েছে।

 

  • চার: যে নামগুলো আল্লাহর জন্য খাস সেসব নামে কোন মাখলুকের নাম রাখা বা কুনিয়ত রাখা হারাম। যেমন- আল্লাহ, আর-রহমান, আল-হাকাম, আল-খালেক ইত্যাদি। তাই এসব নামে কোন মানুষের নাম রাখা সমীচীন নয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে যেগুলো শুধু আল্লাহর জন্য খাস নয়; বরং সেগুলো আল্লাহর নাম হিসেবেও কুরআন হাদিসে এসেছে এবং মাখলুকের নাম হিসেবেও এসেছে সেসব নাম দিয়ে মাখলুকের নাম রাখা যেতে পারে। কুরআনে এসেছে- قَالَتِ امْرَأَةُ الْعَزِيزِ অর্থ- “আলআযিযের স্ত্রী বলেছেন”[সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫১]।

মুহাম্মাদ নাম রাখা যাবে কিনা?

নবীজির নামে নাম রাখা প্রশংসনীয় : একাধিক বিশুদ্ধ হাদিসে নবীজি (সা.) তাঁর নামে নাম রাখতে উৎসাহিত করেছেন এবং তাঁর উপনাম গ্রহণে নিরুৎসাহী করেছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তির ছেলেসন্তান জন্মাল। সে তার নাম রাখল মুহাম্মদ। তাঁর গোত্রের লোকেরা বলল, আমরা তোমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নামে নাম রাখতে দেব না। সেই ব্যক্তি তাঁর ছেলেকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গেল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার একটি ছেলে হয়েছে আমি তাঁর নাম রেখেছি মুহাম্মদ। কিন্তু আমার গোত্রের লোকেরা বলছে, আমরা রাসুলের নামে নামকরণ করতে দেব না।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার নামে নাম রাখো; কিন্তু আমার উপনাম গ্রহণ কোরো না। নিশ্চয়ই আমিই কাসেম বা বণ্টনকারী। আমি তোমাদের মধ্যে বণ্টন করি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৩৩)

শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা
শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

বাচ্চার নাম রাখার নিয়ম

শিশুর নাম রাখার অধিকারী হলেন প্রথমত পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন, ফুফু-খালা, চাচা-মামা এবং আত্মীয়স্বজন। নাম যেন অর্থবহ হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য কোনো বিজ্ঞজন বা আলেমের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। কখনো কখনো কোনো মুরব্বি বা বুজুর্গ ব্যক্তির মাধ্যমেও নামকরণ করা হয়ে থাকে।

নাম রাখার অনুষ্ঠান

সপ্তম দিনে আকীকা করা সুন্নাত। রাসূল সা. বলেন, ‘প্রত্যেক শিশু তার আকীকার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবেহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়’ (আবু দাঊদ হা/২৮৩৮)। অন্য হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল সা. সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিনে তার নাম রাখতে, মাথা মুন্ডন করতে এবং আকীকা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন’ (তিরমিযী হা/২৮৩২)। তবে জরুরি কারণে সপ্তম দিনের পরে যেকোন দিন আকীকা করা যেতে পারে (তুহফাতুল মাওলূদ ১/৬৩; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/৪৩৯; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৫/২১৫)।

শাফেঈ বিদ্বানগণের মতে সাত দিনে আকীকার বিষয়টি সীমা নির্দেশ মূলক নয় বরং এখতিয়ার মূলক। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, সাত দিনে আকীকার অর্থ হল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আকীকা করবে না (নায়লুল আওত্বার ৫/১৫৮ পৃ.; ছহীহাহ হা/২৭২৬)।

 

শেষ কথা

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা
শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *