আশুরার ইতিহাস | কারবালার প্রকৃত ইতিহাস | মহররমের রোজা

আশুরার ইতিহাস | কারবালার প্রকৃত ইতিহাস | মহররমের রোজা

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ ৷ সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন ৷ নিশ্চয় আপনি আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ৷ বক্ষমান আর্টিকেলে আশুরা সংক্রান্ত বিষয় আমরা বিস্তারিত আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ ৷ আশুরার ইতিহাস | কারবালার প্রকৃত ইতিহাস | মহররমের রোজা ৷ এ নিয়ে থাকবে বিস্তারিত কথা ৷ শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন ৷

আরও পড়ুনঃ ইসলামে জন্মনিয়ন্ত্রণ কি জায়েজ?

আশুরা কি?

হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম মাস। এ মাসের দশ তারিখকে বলে আশুরা। আশুরা শব্দের শাব্দিক অর্থ দশমী। এই আশুরার দিন রাসূল (সা:) রােজা রাখতেন এবং অন্যান্য সাহাবীদের রােজা রাখতে বলতেন।

একবার এক ইহুদী আশুরার দিন রােজা আছে শুনে রাসূল (সা:) জিজ্ঞেস করলেন, “তােমরা এদিনে রােজা রাখ নাকি?’ ইহুদি বললাে, “হ্যা আমরা আশুরার দিনে একটি রােজা রাখি।’ রাসূল (সা:) বললেন, “আল্লাহর কসম আগামী বছর থেকে এই মাসে আমরা দু’টো রােজা রাখব।”

হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরাইশরা অজ্ঞতার যুগে আশুরার দিন রােজা রাখত এবং নবী (সা:) ও ঐদিন রােজা রাখতেন। যখন তিনি মদীনা আসলেন তখন তিনি ঐদিন রােজা রাখলেন এবং লােকদের রােজা রাখতে আদেশ দিলেন। যখন রমজানের রােজার হুকুম অবতীর্ণ হলাে তখন যার ইচ্ছা হতাে সে আশুরার দিন রােজা রাখত আর যার ইচ্ছা হতাে না সে রােজা রাখত ।” [বুখারী শরীফ]

আশুরার রোজার ফজিলত

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، رَجُلٌ أَتَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ كَيْفَ تَصُومُ فَغَضِبَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا رَأَى عُمَرُ – رضى الله عنه – غَضَبَهُ قَالَ رَضِينَا بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ غَضَبِ اللَّهِ وَغَضَبِ رَسُولِهِ ‏.‏ فَجَعَلَ عُمَرُ – رضى الله عنه – يُرَدِّدُ هَذَا الْكَلاَمَ حَتَّى سَكَنَ غَضَبُهُ فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ بِمَنْ يَصُومُ الدَّهْرَ كُلَّهُ قَالَ ‏”‏ لاَ صَامَ وَلاَ أَفْطَرَ – أَوْ قَالَ – لَمْ يَصُمْ وَلَمْ يُفْطِرْ ‏”‏ ‏.

‏ قَالَ كَيْفَ مَنْ يَصُومُ يَوْمَيْنِ وَيُفْطِرُ يَوْمًا قَالَ ‏”‏ وَيُطِيقُ ذَلِكَ أَحَدٌ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ كَيْفَ مَنْ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا قَالَ ‏”‏ ذَاكَ صَوْمُ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ كَيْفَ مَنْ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمَيْنِ قَالَ ‏”‏ وَدِدْتُ أَنِّي طُوِّقْتُ ذَلِكَ ‏”‏ ‏.‏ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ ثَلاَثٌ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ فَهَذَا صِيَامُ الدَّهْرِ كُلِّهِ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ ‏”‏ ‏.

আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত :

এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কিভাবে সওম পালন করেন? তার এ কথায় রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসন্তুষ্ট হলেন।

‘উমার (রাঃ) তাঁর অসন্তোষ লক্ষ্য করে বললেন, “আমরা আল্লাহ্‌র উপর (আমাদের) প্রতিপালক হিসেবে, ইসলামের উপর (আমাদের) দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর আমাদের নবী হিসেবে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে তাঁর ও তাঁর রসূলের অসন্তোষ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি”। উমার (রাঃ) কথাটি বার বার আওড়াতে থাকলেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসন্তোষের ভাব দূরীভূত হ’ল।

তখন ‘উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! যে ব্যক্তি সারা বছর সওম পালন করে তার অবস্থা কিরূপ? তিনি বললেন, সে সওম পালন করেনি এবং ছেড়েও দেয়নি। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, যে ব্যক্তি একদিন পর একদিন সওম পালন করে তার অবস্থা কিরূপ? তিনি বললেন, এটা দাঊদ (আঃ)-এর সওম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, যে একদিন সওম পালন করে ও একদিন করে না, তার অবস্থা কিরূপ? রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আশা করি যে, আমার এতটা শক্তি হোক।

তিনি পুনরায় বললেন, প্রতি মাসে তিনদিন সওম পালন করা এবং রমাযান মাসের সওম এক রমাযান থেকে পরবর্তী রমাযান পর্যন্ত সারা বছর সওম পালনের সমান। আর ‘আরাফাহ্ দিবসের সওম সম্পর্কে আমি আল্লাহ্‌র কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। আর ‘আশুরার সওম সম্পর্কে আমি আল্লাহ্‌র কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহের কাফ্‌ফারাহ্‌ হয়ে যাবে। [ই.ফা. ২৬১৩, ই. সে. ২৬১২]

 

রমজানের রােজা ফরজ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশুরার রােজা ওয়াজিব ছিল

ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন “আমি নবী (সা:)-কে এ দিন অর্থাৎ মাহে রজমান ভিন্ন আর কোনাে দিনকে অধিক ফজিলতের বলে মনে করে রােজা রাখতে দেখিনি।’ (বােখারী ও মুসলিম) সালামা ইবনুল আকওয়া (রা:) হতে বর্ণিত। নবী (সা:) আসলাম গােত্রের এক ব্যক্তিকে হুকুম করেন, সে যেন জনগণের মধ্যে ঘােষণা করে দেয়, যে ব্যক্তি কিছু খেয়ে ফেলেছে সে যেনাে বাকী দিন রােজা রাখে। আর যে এখনাে কিছু খায়নি সে যেনাে রােজা রেখে দেয়। কেননা আজ হলাে আশুরার দিন।’ [সহীহ বােখারী]

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান একবার মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, হে মদীনাবাসী। তােমাদের আলেমগণ কোথায়? আমি রাসূল (সা:)-কে বলতে শুনেছি, এটি আশুরার দিন। আল্লাহ তােমাদের উপর এ দিন রােজা রাখা ফরজ করেননি। আমি রােজা রেখেছি। তাই যার ইচ্ছা রােজা রাখতে পারে আর যার ইচ্ছা নাও রাখতে পারে। [সহীহ বােখারী]

আশুরা সম্পর্কে উপরােক্ত হাদিসগুলাে ছাড়া আর কোনাে হাদিস নির্ভরযােগ্য। কোনাে হাদিস গ্রন্থে নেই।

দশই মহররমের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী

  • ১. কথিত আছে এই দিনে আল্লাহ পাক আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করেন।
  • ২. আদম (আ:)-এর তওবা কবুল করে তাকে ক্ষমা করেন।
  • ৩. দীর্ঘ দিন পানিতে ভাষার পর এই দিনে নুহ (আ:)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে
    থামে।
  • ৪. এই দিনে ইব্রাহিম (আ:)-এর জন্ম।
  • ৫. এই দিনে ইদ্রিস (আ:)-কে জীবন্ত জান্নাতে তুলে নেওয়া হয়।
  • ৬. এই দিনে ইব্রাহিম (আ:) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে বের হয়ে আসেন।
  • ৭. এই দিনে আল্লাহপাক মুসা (আ:) এর উপর তাওরাত নাযিল করেন।
  • ৮. এই দিনে মুসা (আ:) বনী ইসরাইলদের নিয়ে নিরাপদে নীলনদ অতিক্রম
    করেন এবং ফেরাউন তার দলবল নিয়ে নীলনদে নিমজ্জিত হয়।
  • ৯. এই দিনে ইউসুফ (আ:) গভীর কূপ থেকে উদ্ধার পান।
  • ১০. এই দিনে চল্লিশ বছর পর ইউসুফ ও ইয়াকুব (আ:)-এর পুনর্মিলন হয়।
  • ১১. ইউনুস (আ:) মাছের পেট থেকে উদ্ধার পান।
  • ১৩. যাকারিয়া (আ:) পুত্র সন্তান লাভ করেন।
  • ১৪. সুলায়মান (আ:) রাজত্ব ফিরে পান। এছাড়া প্রাচীন বিশ্বের আরও বহু সুসংবাদে সমৃদ্ধ এই দিন।

উল্লিখিত তথ্যগুলাে সঠিক না বেঠিক তা জানি না। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ওয়ায়েজিনদের মুখে ঐসব কথা আমরা শুনে আসছি। বিভিন্ন বই পুস্তক ও পত্র পত্রিকায়ও এসব বিষয়ে পড়েছি। যদিও এসবের বিশ্বাসযােগ্য ও নির্ভরযােগ্য কোনাে দলিল নেই। তাছাড়া কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিতও নয় এই তথ্যগুলাে।

সহীহ হাদিস থেকে কেবল একটি বিষয়ই জানা যায় যে, এ দিনে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করেন। হাদিসটি বােখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে।

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَدِمَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةَ فَرَأَى الْيَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ مَا هَذَا قَالُوا هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوسَى قَالَ فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ

ইব্‌নু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত :

তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ ‘আশুরার দিনে সওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সওম পালন কর কেন?)

তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আ) সওম পালন করেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে সওম পালন করেন এবং সওম পালনের নির্দেশ দেন।
[সহীহ বুখারী: ২০০৪]

উপরােক্ত হাদিসটি ছাড়া এই দিনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আর কোনাে ঘটনা ঘটেছে বলে আদৌ জানা যায় না। অনেকে আবার ছাপার অক্ষরে কোনাে ধর্মীয় কথা লেখা দেখলেই তাকে বলে হাদিস। অবশ্য এসব ঘটনা বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে ঈমান আমল ও ইবাদাতের কোনাে সম্পর্ক নেই। এই সব ঘটনা যদি মিথ্যা হয় তাতে আমাদের কি ক্ষতি? আর যদি সত্যি হয় তাতেই বা আমাদের কি এসে যায়?

আরও দেখুনঃ ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম

আশুরার রোজা কয়টি

অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
হাদীসে এসেছে,

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরার রোযা রাখ ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২১৫৪, ১/২৪১]

উপরোক্ত হাদিসগুলোর আলোকে প্রমাণিত হয় যে আশুরার রোজা হবে দুটি—মহররমের ১০ তারিখ একটি, আর ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখ আরো একটি।

কারবালার প্রকৃত ইতিহাস

আশুরার ইতিহাস ৷ কারবালার প্রকৃত ইতিহাস
আশুরার ইতিহাস ৷ কারবালার প্রকৃত ইতিহাস

এই দিনটি যে কারণে আমাদের হৃদয়ে চির ভাস্বর হয়ে আছে, হৃদয়ের গভীরে ব্যথা চিন চিন করে ওঠে, নিজের অজান্তে চোখের পাতা ভিজে যায়। তা হলাে, প্রিয়তম নবীজির প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হােসাইন ও তার পরিবারের মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা।

যদি এমন হয় কোনাে একটি নির্দিষ্ট দিন- আপনার ভাইয়ের ছেলের জন্মদিন। ঐ দিনটি আপনার বােনের মেয়ের বিয়ের দিন কিংবা ঐ দিনটি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কোনাে বড় ধরনের মুসিবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার দিন। আর ঐ দিনটিই আপনার সন্তানের, আপনার জানের টুকরার মৃত্যুদিন। তাহলে আপনি কি করবেন?

নিশ্চয় আপনি অন্য সব অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে নিজের মৃত সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। আর সে মৃত্যু যদি হয় সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে, দ্বীনের পথে আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত রাখতে যেয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে, বাতিলের হাতে, তাগুতের হাতে নির্মম ও নৃশংসভাবে রক্তে ভিজিয়ে দিয়েছে মরুভূমির বালু। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও ছটফট করেছে পিপাসায়-এক ফোটা পানির জন্য। বলুনতাে সেই দিনটি প্রতিবছর যখন ঘুরে ঘুরে আসে আপনার সামনে, তখন কোন ঘটনা আপনার আগে স্মরণ হবে? আপনার ভাইয়ের ছেলের জন্মদিন। উৎসব? নাকি বােনের মেয়ের বিবাহ বার্ষিকী? কিংবা বন্ধুর বিপদ মুক্তির কথা?

আপনার হৃদয় মন দেহ সব ব্যথায় জর্জরিত হয়ে থাকবে না আপনার জানের। টুকরার শাহাদাতের ঘটনায়? তেমনি এই দিনে মুসা (আ:) বনী ইসরাইলদের ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন তাতে আমারা খুশি ৷ ঠিক আছে ৷ কিংবা ইউসুফ (আ:) কূপ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন তাতেও আমাদের ভালো লাগে ৷ অনেক ঘটনার উল্লেখ করে এই দিনটিকে তুলে ধরা হয় আনন্দের দিন, খুশির দিন, উৎসবের দিন হিসেবে। হোক ৷ তবে এই দিনটি তাে আমাদের শােকের দিন। আমাদের শিক্ষার দিন, ত্যাগের দিন। আমাকে জানতে হবে আমার ইতিহাস।

কি করে সম্ভব হলাে রাসূল (সা:) এর ওফাতের পঞ্চাশ বছর যেতে না যেতেই কি করে? কোন অপরাধে? রাসূল (সা:) এর জানের টুকরা যাকে তিনি পিঠের উপর তুলে ঘােড় হয়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন আদরে সিক্ত করেছেন। বলেছেন, হাসান, হােসাইন আমার জানের টুকরা-জান্নাতের দুটি ফুল। বলেছেন তােমরা আমার পরিবারের লােকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করাে না।’

হোসাইন রাঃ সম্পর্কে কয়েকটি সহীহ হাদিস

হযরত আবু হােরায়রা থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা:) বলেছেন “যে ব্যক্তি হাসান ও হােসাইনকে ভালােবাসবে সে অবশ্যই আমাকে ভালােবাসবে । আর যে তাদের প্রতি দুশমনী রাখবে, সে অবশ্যই আমার প্রতি দুশমনী রাখে। (ইবনে মাজা)

হযরত যায়েদ ইবনু আরকাম বলেন, নবী করীম (সা:) হযরত আলী, হযরত ফাতেমা, হযরম হাসান ও হযরত হােসাইন (রা:) কে লক্ষ্য করে বলেন, “আমি শান্তিকামী হব তার প্রতি যার প্রতি তােমরা আপােষকামী হও। আর আমি বৈরী হবাে তার প্রতি, তােমরা যার সাথে বৈরীতা পোষণ করবে।”

রাসূল (সা:) হােসাইন (রা:) গলায়, মুখে চুমু দিতে দিতে বলতেন, ‘হােসাইন হল আমার অংশ আর আমি হােসাইনের। যে হােসাইনকে মহব্বত করবে সে যেনাে আমাকে মহব্বত করে। হােসাইন নবী বংশের মাঝে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।” (ইবনে মাজা)

ভাবতে গেলে ক্ষোভে দুঃখে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেতে চায় রাসূল (সা:) এর এই প্রিয়তম নাতির পবিত্র মুখে ছড়ি দিয়ে আঘাত করেছিল পাপিষ্ঠ এজিদের পদলেহী উবায়দুল্লাহ ইবনু জিয়াদ। যা দেখে নিরুপায় সাহাবী আবু বারজা (রা:) বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে এয়াজিদের সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে যান।

হযরত আবু সাইদ খুদরী (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা:) বলেছেন হাসান। এবং হােসাইন জান্নাতবাসী যুবকদের নেতা। (তিরমিযী) শীতকালে একবার নবী (সা:) শিশু হাসান ও হােসাইনকে চাদর আবৃত করে বসে ছিলেন। তাদের দেখা যাচ্ছিল না। সাক্ষাত প্রার্থী সাহাবী আবু সালমা ইবনু যায়েদ জানতে চাইলেন যে চাদরে আবৃত কি? নবী (সা:) তাদের বের করে দেখালেন। আর বললেন, “এরা দুজন আমার নাতি এবং আমার মেয়ের সন্তান। হে আল্লাহ আমি এদেরকে ভালোবাসি তাই তুমিও এদেরকে ভালােবাস। আর যারা এদেরকে ভালােবাসবে তুমি তাদেরকেও ভালোবেসাে।’ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর বলেন যে, তিনি নবী করীম (সা:)-কে বলতে শুনেছেন নিশ্চয় হাসান এবং হোসাইন এই দুনিয়ায় আমার দু’টি খুশবুদার ফুল।

হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেন, নবী (সা:) হযরত ফাতিমা (রা:)-কে প্রায়ই বলতেন আমার নাতি দুটিকে ডেকে আন। তারা আসলে তিনি তাদের ঘ্রাণ | নিতেন, চুমু দিতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতেন।’ (তিরমিযী)

সেই প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হােসাইনকে নির্মমভাবে শহীদ করে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্নধার হয়ে বসল তারা-যারা প্রায় সারাটি জীবন রাসূল (সা:)-এর বিরােধীতা করে এসেছে।

কারবালা কোথায় অবস্থিত?

কারবালা কোথায় অবস্থিত
কারবালা কোথায় অবস্থিত

কারবালা একটি শহর যা ইরাকের মধ্য-দক্ষিণে অবস্থিত ৷ এবং বাগদাদ হতে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণাংশে অবস্থান। পবিত্র শহরের মধ্যে এটি অন্যতম কারণ কারাবালা ময়দান যেখানে এখানে নবী কারীম (সাঃ) অতি আদরের দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ) শহীদ হোন এবং তাঁর কবরস্থান অবস্থিত।

কারবালার সঠিক ইতিহাস ও কারবালা যুদ্ধের কারণ

সংক্ষিপ্ত ঘটনা। ৬০ হিজরীর রব মাসে আমীর মুয়াবিয়া পীড়িত হন এবং সেই পীড়িতেই ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বেই তিনি উমাইয়া রাজবংশের গােড়াপত্তন করে যান ৷ নিজ অযােগ্য পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকার মনোনয়নের মাধ্যমে ৷

এই প্রসঙ্গে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী লিখিত তারিকুল খােলাফায় বলা হয় হিজরী ৫০ সালে মুয়াবিয়া তার ছেলেকে রাষ্ট্র প্রধান করার অঙ্গীকার করার জন্য সিরিয়াবাসীদের আহ্বান জানান। তারা তখন বায়াত করেন। মুয়াবিয়া হলেন। প্রথম ব্যক্তি যিনি নিজ ছেলের জন্য খেলাফতের অঙ্গীকার করার বায়াত নিলেন। তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সুস্থ অবস্থায় খেলাফতের ব্যাপারে আগাম অঙ্গীকার নিয়ে নিজ পুত্রকে যুবরাজ বা অলিয়ে আহাদ নিযুক্ত করলেন। (তারিখুল খোলাফা-১৮৩ পৃ:)

ইতিপূর্বে নিজেও মুসলিম জাহানের ক্ষমতা হস্তগত করেছিলেন নৃশংসতা, ধােঁকা, প্রতারণা ও কূট চালের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেই তিনি এমন সব লােককে প্রশাসনের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন যারা-মােটেও ভালাে লােক ছিল না ৷

ইসলামের ধার তারা কমই ধারতাে। যেমন মদীনার গভর্নর পদে বসিয়েছিলেন মারওয়ান ইবনে হাকামকে, অথচ এই মারওয়ান এবং তার বাবা হাকামকে রাসূল (সা:) দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন তাদের বাজে কৃতকর্মের জন্য।

হযরত আবু বকর (রা:) তাদের দেশে আসার অনুমতি দেননি। হযরত ওমর (রা:) ও তাদের দেশে আসার অনুমতি দেননি। হযরত ওসমান (রা:) তাদের দেশে আনেন-আর আমীর মুয়াবিয়া মারওয়ানকে মদীনার গভর্নর পদে বহাল করেন।

এই মারওয়ান উপর দিয়ে মুসলমান হলেও ভিতরে রাসূল (সা:) এর শিক্ষা ও তাঁর পরিবার পরিজনের শত্রুই ছিল এই মারওয়ান ইবনে হাকাম। মারওয়ান ইবনে হাকাম যখন ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করার কথা ঘােষণা করল তখন দ্বীনের অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন মদীনার কতিপয় ন্যায়বাদী ব্যক্তি সামনে অগ্রসর হলেন এবং খােলাখুলিভাবে বিরােধিতা করলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর বললেন, তুমি এবং মুয়াবিয়া উভয়েই ভুল করছাে, এতে উম্মাহর কল্যাণ নিহিত নেই। বরং খেলাফতকে বাদশাহীতে রূপান্তর করতে চাচ্ছ।’

মারওয়ান বললাে, আমিরুল মুমিনীন আমীর মুয়াবিয়া আবু বকর (রা:) ও ওমর (রা:)-এর মতাে ইয়াজিদকে মনােনীত করে যেতে চান। জবাবে আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর জানালেন, এটা আবু বকর ও ওমর (রা:)-এর সুন্নত নয়। এটা কাইসার ও কিসরার অনুসৃত পথ। হযরত আবু বকর (রা:) ও ওমর (রা:) তাদের সন্তানদের উত্তরাধিকার বানাননি। বসরার রইস আহনাফ বিন কায়েস আমীর মুয়াবিয়াকে বললেন, “আমরা তাে মহাসমস্যায় পড়েছি, যদি সত্য কথা বলি তাহলে আপনার ভয় রয়েছে আর যদি মিথ্যা বলি তাহলে আল্লাহর ভয় রয়েছে।

যা হােক আমীর মুয়াবিয়া কিছু লােককে ভয় ভীতি দেখিয়ে আর কিছু লােককে দান-দক্ষিণা দিয়ে নিজের অনুগত করে নিলেন। ইরাক ও সিরিয়ার জনগণ ইয়াজিদের বায়াত কবুল করল কিন্তু হেজাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কেউই বায়াত নিতে রাজি হলেন না ৷ তারা আব্দুল্লাহ বিন জোবায়েরকে নিজেদের প্রতিনিধি বানালেন ও তার মাধ্যমে বললেন, খলিফা নির্বাচনের তিন ধরনের উদাহারণ রয়েছে। আপনি এর যে কোনাে একটি অনুসরণ করুন। যেমন-

  • ১. কাউকেই মনােনীত করবেন না, যেভাবে রাসূল (সা:) কাউকেই মনােনীত করেননি। মুসলমানরা নিজেরাই কাউকে মনােনীত করে নেবে।
  • ২. অথবা আবু বকরের (রা:)-এর মতাে কাউকে মনােনীত করুন যার সাথে আপনার কোনাে সম্পর্ক নেই, অথচ সে হবে যােগ্য ব্যক্তি।
  • ৩. অথবা ওমর (রা:) এর মতাে কতিপয় ব্যক্তির মজলিশে শূরার উপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিন। আমীর মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এসব প্রস্তাবের একটিও মানলেন না। উমাইয়া বংশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এ তিনি কিছুতেই চাচ্ছিলেন না, তার সিদ্ধান্তে তিনি অটল থেকেই ইন্তেকাল করেন।

তার জীবদ্দশায় যারা ইয়াজিদের বায়াত করেননি তারা তার মৃত্যুর পরও বায়াত করতে অস্বীকার করলেন। আমীর মুয়াবিয়া যদিও ছল চাতুরী যুদ্ধ-বিগ্রহ করে মুসলিম জাহানের ক্ষমতাধর হয়েছিলেন। তার উপর তৎকালীন জ্ঞানী-গুণী অনেক সাহাবা অসন্তুষ্ট ছিলেন। যেমন একবার তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা:) এর নিকট এসে বললেন, ‘আম্মা আমি তাে আপনারই সন্তান। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, না তুমি রক্ত পিপাসু হোর পুত্র। যা হােক তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাকে সবাই বরদাস্ত করে নিয়েছিলেন এই কারণে যে, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন।

কিন্তু ইয়াজিত ছিল মদ্যপ, বেনামাজি তার আচার আচরণ ছিল জাহেলিয়াতের রঙে রঞ্জিত। ইয়াজিদ ক্ষমতার মসনদে বসেই ঐ সব ব্যক্তিদের বায়াত গ্রহণের দিকে নজর দেয় যার তার উত্তরাধিকার মেনে নেয়নি। মদীনার গভর্নর ওলীদ বিন ওকবার এ ইয়াজিদ এইমর্মে লিখিত আদেশ জারী করে যে, ইমাম হােসাইন ইবনে আলী। আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের, আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর এবং আঃ ইবনে ওমরের বায়াত যেনাে অতি সত্ত্বর আদায় করা হয়। মারওয়ান তখন ইয়াজিদের প্রধান উপদেষ্টা। মারওয়ান পরামর্শ দিলো । এই সকল ব্যক্তি বায়য়াত করতে রাজি না হয় তবে যেনাে তাদের হত হয়। এই মারওয়ানের ষড়যন্ত্রেই হযরত ওসমান (রা:)-এর আমলে বিদ্রোহ বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে হযরত ওসমান (রাঃ) হয়ে গেছেন। হযরত আলী (রা:) এর সাথে আমীর মুয়াবিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

ফেসবুকে আমরা

শেষ কথাঃ

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *