২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য

২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য

 

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ৷ সুপ্রিয় পাঠক! সবাই কেমন আছেন? আপনাদের সবাইকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা ৷ আসছে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির গর্ব, অহংকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ৷ এই দিবসকে কেন্দ্র করে দেশে বিদেশে চমৎকার সব আয়োজন পালিত হয় ৷ ভাষা দিবসের বক্তৃতা প্রতিযোগিতা হয় ৷ বিভিন্ন সভা সমাবেশ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ৷ এ অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদের বক্তৃতা দিতে হয় ৷ বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা থাকে ৷ তাই অনেকেই তার বক্তৃতাকে তথ্য সমৃদ্ধ করে সাজানোর জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য তালাশ করেন ৷ তাদের জন্য আমাদের আজকের আয়োজন ৷ একুশে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ৷

আরও পড়ুনঃ বিজয় দিবসের বক্তৃতা

২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য

মাননীয় সভাপতি, শ্রদ্ধেয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট অন্য অতিথিবৃন্দ, সমবেত সুধীমণ্ডলী! সবাইকে আমার সালাম ও শুভেচ্ছা। শুরুতেই, আজকের এই মহান দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বায়ান্নর ভাষা শহিদদের প্রতি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ৷ একুশে ফেব্রুয়ারি নানা মাত্রিকতায় গৌরবোজ্জ্বল ও মহিমান্বিত করেছে বাঙালি জাতিকে। একুশে আমাদের সাহসের প্রতীক। প্রতি বছর বাঙালির জীবনে একুশে ফিরে আসে স্বদেশী চেতনা ও উজ্জীবনের বার্তা নিয়ে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য ছাত্র-জনতার রক্তে রচিত হয়েছে বাঙালির যে ইতিহাস, সেটিই আমাদের মাথানত না করার চিরকালীন প্রেরণা হয়ে আছে।

 

সম্মানিত সূধী! মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের স্রষ্টা। মানুষকে শিক্ষা দিলেন ভাষা। মূলত ভাষা আল্লাহর দান। যা বান্দার জন্য নিয়ামত। আমরা বাঙালি, মাতৃভাষা বাংলা। ভাষা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে ঘোষণা করেন- ‘দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন আল-কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা।’ (সূরা আর রহমান) মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন- ‘তার আরো এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম-২২) ভাষা বলতে নির্দিষ্ট কোনো ভাষা বুঝানো হয়নি। এখানে সব ভাষাই আল্লাহর নিদর্শন। বিশ্বনবী সা: বলেন, ‘তিন কারণে আমি আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। আমি আরবিভাষী, আল কুরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতের ভাষা আরবি।’

 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

 

প্রিয় উপস্থিতি! একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার আন্দোলনের দিন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে গিয়ে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাই শহীদদের স্মরণে ২১ শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হয়। আবার অনেকেই জানতে চেয়েছেন ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলা কত তারিখ। এ বছরের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন অনুষ্ঠিত হবে। তাই আপনারা যারা ২১ শে ফেব্রুয়ারি বক্তৃতা পেতে চান। তাদের জন্য এখানে ২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়া হয়েছে।

২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য
২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য

 একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এ কথাটি ভাবতেই আমাদের বুক গর্বে ভরে ওঠে। নানা দেশের মানুষ এখন বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ভাষা শহিদদের সম্মানে আজকের এই মহান দিবসটি উদযাপন করেন। ভাষা জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। একই ভাষায় কথা বলার অর্থ হচ্ছে একে অন্যের ভাবনার শরিক হওয়া। অনুভব ভাগ করে নেয়া। মানুষ অন্য গোষ্ঠী বা জাতির সাংস্কৃতিক চেতনা ও আচরণের সন্ধান পায় এই ভাষার মাধ্যমেই। ভাষা জাতীয়তাবাদী চেতনারও বড় বাহন। জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, জাতি গঠন কিংবা জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা বিকাশে সাধারণ একটি ভাষার গুরুত্ব অসাধারণ। মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরেই জাতির বেড়ে ওঠা, পথচলা। তাই ভাষা মানুষের অস্তিত্বেরও অংশ। ভাষা অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকারও মাধ্যম। উৎপাদনের সঙ্গে ভাষার রয়েছে নিবিড় সংযোগ। মানুষকে সেই যোগাযোগের মাধ্যম থেকে বঞ্চিত করা মানেই উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। এরূপ পরিস্থিতিতে মানুষ মনে করে তার বেঁচে থাকার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। আর সে কারণেই মানুষ সংগ্রাম করে সেই নিরাপত্তাকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য। বিষয়টি মনস্তাত্বিকও বটে।

মাতৃভাষা দিবসের বক্তৃতা

মায়ের ভাষাকে কোনোভাবেই অবরুদ্ধ কিংবা ধ্বংস করা যায় না। মাতৃভাষার ওপর আঘাত এলে তাই আত্ম অভিমানে লাগে। মানুষ তখন স্বভাবসুলভ বিদ্রোহ করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাঙালি জাতি। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আসীন করতে আমরা প্রাণ দিয়েছি। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি।

 

আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ যদি এক অবিভক্ত রাষ্ট্ররূপে স্বাধীনতা লাভ করত, তাহলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলাই সম্ভবপর হতো না। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মহাত্মা গান্ধী প্রশ্ন করেছিলেন, যদি ভারত স্বরাজ লাভ করে, তবে এদেশের সাধারণ ভাষা কী হবে? জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, হিন্দী।

 

রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ভারতবর্ষের তিনটি ভাষার রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা ও সম্ভাবনা রয়েছে। ভাষা তিনটি হলো: বাংলা, উর্দু ও হিন্দী। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য যে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ছিল তা এখন সুপ্রমাণিত। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের রাষ্ট্রভাষা যথাক্রমে বাংলা, উর্দু ও হিন্দী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পৌনে দু’শ বছরের বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে অবিভক্ত অবয়বে নয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসাবে। একটি ভারত, আরেকটি পাকিস্তান। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অখন্ড। অপর পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে। হাজার মাইলেরও অধিক দূরত্বে অবস্থিত দু’টি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।

 

পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, যা পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, তার চারটি প্রদেশ ছিল: পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। আর পূর্বাঞ্চলে একমাত্র প্রদেশ ছিল, যার নাম ছিল পূর্ববাংলা। পূর্বাঞ্চলের এই একটি প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল পশ্চিমাঞ্চলের চার-চারটি প্রদেশের সর্বমোট জনসংখ্যার চাইতেও অধিক। পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার সবাই ছিল বাংলাভাষী। এই নিরিখে বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি তোলা যেতো। তা অবশ্য তোলা হয়নি। তার জায়গায় উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালিয়ে দেয়ার একটা গোপন চক্রান্ত শুরু হয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষী অবাঙ্গালীরা।

 

সাধারণ ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে বিবেচনায় আনা হয়নি। পূর্ববঙ্গের পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য হিসাবে তার মাতৃভাষা ছিল উর্দু। তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে সম্ভবত ধারণা দিয়েছিলেন যে, পূর্ববঙ্গের জনগণ সবাই উর্দু বোঝে। তিনি যদি জিন্নাহ সাহেবকে এই ভুল ধারণা না দিতেন, তাহলে জিন্নাহ সাহেবের মনে এমন একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হতো না যে, পূর্ব পাকিস্তানের সব লোক উর্দু বোঝে। জিন্নাহ সাহেব খাজা নাজিমুদ্দীনের কথায় বিশ্বাস করে তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে রেসকোর্স ময়দানে এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন, যার ফলে নতুন করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে মৃত্যু শয্যায় জিন্নাহ সাহেব তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বখসের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে বলেছিলেন, আমি অন্যের কথায় বিশ্বাস করে জীবনে বেশ কিছু ভুল করেছি। এর অন্যতম হলো আমার রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করা। এ বিষয়টা আমার গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। এ তথ্য আমরা জানতে পেরেছি বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে।

কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। এরপর পাকিস্তানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা লিয়াকত আলী খানও পরবর্তীকালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধান নেতা হিসেবে ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদানকালে বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।

 

অথচ এই খাজা নাজিমুদ্দীনই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যে খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৮ সালের জিন্নাহ সাহেবের সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে স্বাক্ষর করেন, সেই খাজা নাজিমুদ্দীনই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প ঘোষণা করেন। এটা ভাষা সংগ্রাম পরিষদ অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করে এবং তার এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ হিসাবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস এবং হরতালের ডাক দেয়। এর পরের ঘটনা সবার জানা। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ভাষা শহীদ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলেন। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

 

মাতৃভাষার গুরুত্ব

২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য
২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য

মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে আমাদের জানতে হবে “ভাষার” সংজ্ঞা কি? “ভাষা” কাকে বলে?

ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে: মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষ যেসকল সাংকেতিক ধ্বনি উচ্চারণ করে তাকে “ভাষা” বলা হয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, মনের সুখ দুঃখ প্রকাশ করি। কাজেই আমরা বাংলাভাষী। শিশুকালে এই ভাষাতেই আমাদের প্রথম বাক্যস্ফূর্ত হয়েছে। এই ভাষাতেই আমরা আমাদের যাবতীয় আবেগ আহলাদ, আনন্দ-বেদনার প্রকাশ ঘটিয়েছি। এই ভাষায় লিখে পড়ে ও কথা বলতে আমরা যে রকম পছন্দ বোধ করি অন্য কোন ভাষাতে সে রকমটা বোধ করি না ৷ যেমনটি কবির ভাষাতেও উচ্চারিত হয়েছে,

নানা দেশের নানান ভাষা-বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি মনের আশা?

 

সুপ্রিয় শ্রোতাবৃন্দ!

আমি একটু পূর্বে আপনাদের সম্মুখে কুরআনে কারীমের সূরা ইবরাহীমের একখানা আয়াত তিলাওয়াত করেছি। যেখানে মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ পাক বলেছেন: “আমি সমস্ত পয়গাম্বরকে তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাঁরা তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে”। (সূরা ইবরাহীম : ৪)

অন্যত্র আল্লাহ পাক প্রত্যেক ভাষাকে তাঁর কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন আখ্যা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

 

وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ

لَآيَاتٍ لِلْعَالِمِينَ.

অর্থাৎ, “আল্লাহর আরো একটি নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে”। (সূরা রূম: ২২)

বাস্তবিকপক্ষে প্রত্যেকটি ভাষাই আল্লাহ পাকের বিশেষ নেয়ামত। সুতরাং বাংলা ভাষাও মহান আল্লাহর বিশেষ দান। একে বিজাতীয় তথা হিন্দুয়ানী ভাষা আখ্যা দিয়ে নাক সিটকানো হলে তা হবে আল্লাহ পাকের নেয়ামতকে অবজ্ঞা করারই নামান্তর এবং প্রকারান্তরে তাকে অস্বীকার করা।

ভাষা কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে না। বরং ভাষার পরিধি ও বিস্তৃতি অনেক দূরব্যাপী পরিব্যাপ্ত।

সম্মানিত উপস্থিতি!

এটা একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, আপন ভাষায় স্বীয় মনোভাব অন্যের মন মুকুরে বদ্ধমুল করা যতটা সহজ, অন্য কোন ভাষাতেই ততটা সহজ হয় না।

 

আর এ জন্যই তো রাসূলে কারীম মুহাম্মাদ মুসতাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআনে কারীম আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। যেহেতু তিনি ছিলেন আরবের মানুষ। ওটাই ছিল তাঁরমাতৃভাষা। অনুরূপ ভাবে তাউরাত শরীফ হিব্রু ভাষায়, ইঞ্জিল শরীফ সুরিয়ানী ভাষায় ও যবুর শরীফ ইউনানী ভাষায় নাযিল হয়েছে। যেহেতু ঐ কিতাবসমূহের রাসূল আ. গণের [যথাক্রমে হযরত মূসা আ. হযরত ঈসা আ. হযরত দাউদ (আ.)] মাতৃভাষাও ছিলো তাই।

২১ শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য | ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বক্তব্য

মোটকথা, যে নবী যে ভাষায় কথা বলতেন সে নবীর মাতৃভাষা যা ছিলো তাঁকে সে ভাষাতেই কিতাব দেয়া হয়েছে।

 

আর এ সবের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হল যেন তিনি তাঁর মনের ভাব উম্মতের সামনে পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরতে পারেন। বিশদভাবে ব্যক্ত করতে পারেন তাঁর উপর অবর্তীর্ণ কিতাবের কথা।

 

ভাইয়েরা আমার!

দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য এই যে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা আজ সর্বত্রই চরম উপেক্ষা আর অবজ্ঞার শিকার। কী রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, কী অফিস আদালতে, কী স্কুল-কলেজ, আর কী মাদরাসা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

 

ভাবতেও অবাক লাগে, যে ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের কোন এক উজ্জল দিনে দেশের অসংখ্য কৃতী সন্তান জীবন দিল, যাদের মধ্যে আব্দুস সালাম, রফীক, বরকত, আব্দুল জাব্বার প্রমুখ বুকের তাজা লাল খুন ঢেলে দিল পীচঢালা ঢাকার কালো রাজপথে, যে দিনটি ছিলো ৮ই ফালগুন; আজ সেই দিনটি পালিত হচ্ছে ৮ই ফাল্গুনের পরিবর্তে ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে। কোরাস কণ্ঠে গাওয়া হচ্ছে: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?!

 

সত্যিই সেলুকাস এদেশ! বিচিত্র এদেশের মানুষ! অদ্ভুত তাদের মন মানসিকতা! নতুবা যে ভাষার জন্য জান দিল, সে ভাষার নির্ধারিত তারিখ বাদ দিয়ে ভিনদেশী ভাষায় তাও আবার বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে পালনের কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়।

 

আরো লক্ষ্য করুন! আমাদের দেশের অধিকাংশ কিন্ডার গার্টেনগুলোর অবস্থা! সেখানে বাংলা মাধ্যমের পরিবর্তে শিশুদেরকে শেখানো হচ্ছে ইংরেজী মাধ্যমে। যদ্দরুন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের এই শিশুরাছোটকাল থেকেই হয়ে পড়ছে আমেরিকা ও বিলাতমুখী। মাতৃভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব তাদের অন্তর থেকে যাচ্ছে হারিয়ে। বরং ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় যে, মাতৃভাষা, বাংলায় কথা বলাকে তারা অবমাননাকর অপরাধ মনে করে। তাইতো বর্তমানকালের অনেক কেজিতে পড়ুয়া ছোট্ট শিশুকেও বলতে শুনা যায়: “আমি বাংলা স্যান্টেন্স ইউস করাকে লাইক করি না”!!

 

হায়রে আমার সোনার দেশ! হায়রে আমার সোনার মাতৃভাষা! আহা আজ তোমার একি করুণ দশা!

 

উপস্থিত সুধীবৃন্দ!

খুবই দুঃখ লাগে বরং করুণা হয় যখন দেখি যে, আমাদের দেশের আদালতগুলোতে বিচার কার্য চালাতে হয় সেই সাতদশক পূর্বে রেখে যাওয়া ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে! কেন, বাংলায় কথা বললে কি তাদের মর্যাদায় আঘাত লাগে?

আজকে আমাদের কলেজ ভার্সিটি পাস অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী বাংলা বারোটি মাসের নাম সঠিক ভাবে জানে কিনা এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত আগামী কয়েক বৎসর পরের প্রজন্ম বাংলা মাসের নামগুলোকে দুর্বোধ্য কিছু উটকো ঝামেলা মনে করে ডাস্টবিনের বস্তু মনে করে দূরে নিক্ষেপ করবে।

 

উপস্থিত বিদগ্ধ সুধীবৃন্দ!

এতক্ষণের আলোচনায় আপনাদের সামনে আশা করি এ কথা মধ্যাহ্ন প্রভাকরের ন্যায় দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে যে, মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা ও অবহেলা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য আত্ম হননেরই নামান্তর। আর যারা স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করে তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী। সুতরাং আমাদের জাতীয় জীবনকে শক্তিশালী করতে হলে, স্বদেশের প্রতি, মাতৃভূমি আর জন্মভূমির প্রতি মমত্ববোধকে জাগ্রত করতে হলে,পারস্পরিক একতার বন্ধনকে নিবিড় থেকে নিবিড়তর করতে হলে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই তা সম্ভব।

 

আজ তথাকথিত প্রগতিবাদী কিছু সংখ্যক মানুষকে দেখা যায় যে, দু’চার টি ইংরেজী শব্দ বলতে পারলেই হল; তখন আর তাদের কাছে বাংলার গুরুত্ব থাকে না। বরং বাংলায় কথা বলাকে তারা জাতে উঠার পথে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করে! একটু চোখ কান খোলা রেখে আমাদের বর্তমান সমাজের দিকে তাকালেই আপনারা আমার কথার সত্যতা খুঁজে পাবেন। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে চলতে চাই: এটা দাসসুলভ মনোবৃত্তি বৈ অন্য কিছু নয়।

 

আপনারা তাকিয়ে দেখুন ঐ ফ্রান্সের দিকে, ঐ জার্মানীর পানে, সেই চীন ও জাপানের প্রতি, আপন আপন ভাষার ব্যাপারে যত্নবান হয়ে, ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে তারা কী অসাধারণ উৎকর্ষ ও ঈর্ষনীয় উন্নতি লাভ করছে?

 

সাথীরা আমার!

আমি এ কথা বলছি না যে, আপনারা ইংরেজী শিক্ষা বন্ধ করে দিন, আপনারা এ কথা মনে করবেন না যে, আমি ইংরেজী শিক্ষার বিরোধিতা করছি, কক্ষনো নয়। বরং ইংরেজী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যতটুকু রয়েছে তা আমার কাছে বিলকুল স্পষ্ট। বরং বর্তমান জমানায় দ্বীনে ইসলামের হিফাযতের স্বার্থে, বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তাবলীগ তথা দ্বীনের প্রচার-প্রসারকে আরো ব্যাপকতা দানের স্বার্থে সারা বিশ্বে প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। একমাত্র পাগল বা গণ্ডমূর্খই এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারে।

 

আমার কথার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে: আমরা যেন ইংরেজী বা অন্য যে কোন ভাষায় এত অধিক পরিমাণে লিপ্ত হয়ে না পড়ি যাতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অবহেলিত হয়, উপেক্ষার শিকার হয়। যার লক্ষণসমূহ আজ পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ছে। নতুবা যদি কেউ বাংলা ভাষায় পারদর্শী অথবা কমপক্ষে বিশুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখায় যোগ্যাত অর্জন করার পর ভাল উদ্দেশ্যে ইংরেজী শিখে, ফরাসী ভাষা রপ্ত করে, স্পেনীশ ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে, জার্মান ভাষায় ব্যুৎপত্তি হাসিল করে; তবে কি তার যোগ্যতার ঘাটতি হয়?

শেষ কথা

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *