হাবিল কাবিলের কোরবানি | যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল

হাবিল কাবিলের কোরবানি | যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল

আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ ৷ সুপ্রিয় পাঠক! কেমন আছেন? বছর পরিক্রমায় আবারও কুরবানী আমাদের সামনে সমাগত ৷ আগামী ১০ই জিলহজ অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র ঈদুল আযহা তথা কুরবানীর ঈদ ৷ আজ আমরা কথা বলব হাবিল কাবিলের কোরবানি এবং যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল তার বিস্তারিত নিয়ে ৷ আমাদের সঙ্গে থাকুন ৷

আরও পড়ুনঃ কোরবানীর ঈদের নামাজের নিয়ম

কোরবানীর গোশত বণ্টনের নিয়ম

হাবিল কাবিলের কোরবানি | যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল

হাবিল-কাবিলের কুরবানী ৷ বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম আ. এবং মা হাওয়া আ. যখন দুনিয়ায় আগমন করেন এবং সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হয়, তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করতো। তখন আদম আ.-এর সন্তান ব্যতীত যেহেতু অন্য কোন মানুষই ছিল না, তাই আল্লাহ তাআলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম আ.-এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর সহোদর-সহদরা ভাই-বোন বলে গণ্য হবে এবং তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে।

পক্ষান্তরে, পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী কন্যা প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী ভাইয়ের জন্য সহোদরা বোন বলে গণ্য হবে না। একইভাবে প্রথম গর্ভে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী কন্যা সহোদরা বোন বলে গণ্য হবে না। বিধায় এদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বৈধ হবে।

কিন্তু ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ছিল পরমা সুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত বোন ছিল কুশ্রী ও কদাকার। বিবাহের সময় হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের যমজ কুশ্রী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ে। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে যায় এবং সে জেদ ধরে যে, আমার যমজ বোনকে আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। হযরত আদম আ. তাঁর শরীয়তের নিয়মানুযায়ী কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং উভয়ের মতভেদ দূর করার জন্য বললেন, তোমরা উভয়ে আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কুরবানী পেশ কর। যার কুরবানী গৃহীত হবে, সেই উক্ত কন্যাকে বিয়ে করবে।

তৎকালে কুরবানী গৃহীত হওয়ার আলামত ছিল আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে ভস্মিভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেতো। আর যে কুরবানীকে আগুন স্পর্শ করতো না বা জ্বালিয়ে ভস্মিভূত করতো না তা প্রত্যাখ্যাত মনে করা হত। হাবিল ভেড়া-দুম্বা ইত্যাদি পশুপালন করতো তাই সে একটি উন্নত মানের দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করলো। আর কাবিল কৃষিকাজ করতো, তাই সে কিছু শষ্য-গম ইত্যাদি পেশ করলো। আসমান থেকে নিয়মানুযায়ী অগ্নিশিখা নেমে এলো এবং হাবিলের কুরবানীটি জ্বালিয়ে দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে গেল। আর কাবিলের কুরবানী যেমন ছিল তে জমিনে পড়ে রইল।

এ অকৃতকার্যতায় তার ক্ষোভ-দুঃখ বেড়ে গেল এবং আত্মসংবরণ করতে না পেরে সে ভাইকে প্রকাশ্যে বলে দিল, আমি তোমাকে খুন করবো। হাবিল মার্জিত আকারে একটা নীতিগত কথা বললেন-قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰہُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ “আল্লাহ তাআলা তো কেবল খোদাভীরু ও পরহেযগারদের কর্ম গ্রহণ করেন। কুরবানীর বস্তু বা জন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য তাকওয়া।

কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি কেন?
কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি কেন?

কুরবানীর এ কাহিনী আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে এভাবে বর্ণনা করেছেন-

وَ اتۡلُ عَلَیۡہِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِہِمَا وَ لَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ ؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ ؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰہُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۲۷﴾

আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর তাদের একজন থেকে গ্রহণ করা হল, আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হল না। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন’।

لَئِنۡۢ بَسَطۡتَّ اِلَیَّ یَدَکَ لِتَقۡتُلَنِیۡ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیۡکَ لِاَقۡتُلَکَ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰہَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۲۸﴾

‘যদি তুমি আমার প্রতি তোমার হাত প্রসারিত কর আমাকে হত্যা করার জন্য, আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য আমার হাত তোমার প্রতি প্রসারিত করব না। নিশ্চয় আমি সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহকে ভয় করি’।

اِنِّیۡۤ اُرِیۡدُ اَنۡ تَبُوۡٓاَ بِاِثۡمِیۡ وَ اِثۡمِکَ فَتَکُوۡنَ مِنۡ اَصۡحٰبِ النَّارِ ۚ وَ ذٰلِکَ جَزٰٓؤُا الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۚ۲۹﴾

‘নিশ্চয় আমি চাই যে, তুমি আমার ও তোমার পাপ নিয়ে ফিরে যাও, ফলে তুমি আগুনের অধিবাসী হও। আর সেটিই হচ্ছে যালিমদের প্রতিদান’।

فَطَوَّعَتۡ لَہٗ نَفۡسُہٗ قَتۡلَ اَخِیۡہِ فَقَتَلَہٗ فَاَصۡبَحَ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۳۰﴾

সুতরাং তার নফস তাকে বশ করল তার ভাইকে হত্যা করতে। ফলে সে তাকে হত্যা করল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হল।

فَبَعَثَ اللّٰہُ غُرَابًا یَّبۡحَثُ فِی الۡاَرۡضِ لِیُرِیَہٗ کَیۡفَ یُوَارِیۡ سَوۡءَۃَ اَخِیۡہِ ؕ قَالَ یٰوَیۡلَتٰۤی اَعَجَزۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ مِثۡلَ ہٰذَا الۡغُرَابِ فَاُوَارِیَ سَوۡءَۃَ اَخِیۡ ۚ فَاَصۡبَحَ مِنَ النّٰدِمِیۡنَ ﴿ۚۛۙ۳۱﴾

অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যা মাটি খুঁড়ছিল, যাতে তাকে দেখাতে পারে, কীভাবে সে ভাইয়ের লাশ গোপন করবে। সে বলল, ‘হায়! আমি এই কাকটির মত হতেও অক্ষম হয়েছি যে, আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করব’। ফলে সে লজ্জিত হল।
[ সূরা মাইদা: ২৭-৩১]

উক্ত আয়াতগুলিতে কুরবানীর কাহিনী বর্ণনা করতে সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা যে ঘোষণা দিয়েছেন তা হলো- اتۡلُ عَلَیۡہِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ এই بِالۡحَقِّ শব্দের অর্থ : যথাযথভাবে। এ কথাটা বলার কারণ এই নয় যে, নবী কিছু লুকাবেন বা বাড়িয়ে কথা বলবেন (না’উযু বিল্লাহ); বরং এর দ্বারা পুরো উম্মতকে একটা বিশেষ বিষয়ে হিদায়াত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা হলো ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোন প্রকার মিথ্যা জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। এতে নিজের পক্ষ থেকে কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন করা যাবে না।

কারণ, এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে। বিভ্রান্তির শিকার হবে। যেমন আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অবস্থা। যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, সে পাঠ্যপুস্তকে সংস্কার করে আর বলে, আমরা জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। আবার একজন ক্ষমতায় আসলে সেও অনুরূপ দাবি করে যে, আমি বিকৃত ইতিহাস বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জাতিকে উপহার দিতে চাই। এভাবে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে ইতিহাসও পরিবর্তন হতে থাকে। বর্তমান প্রজন্ম এতে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং বিড়ম্বনার শিকার হয়। তাই ইতিহাস যিনিই রচনা করুন না কেন; তার উচিৎ সঠিক ইতিহাস যথাযথভাবে জাতির সামনে পেশ করা।

হাবিল কাবিলের কোরবানি
হাবিল কাবিলের কোরবানি

কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি কেন?

হযরত আদম (আ:) তার সন্তান কাবিল-হাবিল দু’ভাইকে নির্দেশ দিলেন তোমরা তোমাদের সবচে’ মূল্যবান ও প্রিয় জিনিসগুলো মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের নিকট কোরবানি করো। কাবিল-হাবিল দু’ভাইয়ের মধ্যে প্রতিযেগিতা চললো। হাবিল তাঁর বাবা-মায়ের প্রতি বিনয়ী ও অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পশুপালন করতেন। অন্যদিকে কাবিল ছিলেন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল ও অবাধ্য। তিনি কাঠ, ফলমূল সংগ্রহ করতেন। হাবিল তাঁর পশুদের মধ্যে সবচে’ হৃষ্টপুষ্ট পশুটি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের প্রতি কোরবানি করলেও কাবিল তার সংগৃহীত নিকৃষ্ট মানের সামগ্রী উৎসর্গের জন্য পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসেন।

হযরত হাবিলের উৎসর্গের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল, আনুগত্য ছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের নৈকট্য লাভের বাসনা ছিল। সর্বোপরী বাবা-মা তথা হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আ:)-এর বাধ্যগত হয়ে নির্দেশ পালনের দায়িত্ববোধ ছিল। তাই তাঁর কোরবানি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে কবুল হয়ে যায় ৷

অন্যদিকে কাবিলের মধ্যে ঔদ্ধত্য, উচ্ছৃংখলতা ও বাবা-মায়ের এবং নিজ দায়িত্বপালনে হেঁয়ালিপনা অবাধ্যতা তার কোরবানিকে নষ্ট করে দেয়। তাই তাঁর কোরবানি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে কবুল হয়নি। অধিকন্তু, পরবর্তীতে সে শয়তানের নির্দেশ অনুসরণ করে এক সময় ছোটভাই হাবিলকে হত্যা করে। এই ধর্মীয়-ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিত পবিত্র কোরআন শরীফে উল্লেখ থাকায় একজন নিবেদিত মুসলিমের নিকট তা কম-বেশী জানা রয়েছে বলে আমি মনে করি। তবে এর কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। তাহলে আমাদের মহান ত্যাগ ও নিজ নিজ কষ্টার্জিত কোরবানি সফল হতে পারে।

শেষ কথা

সুপ্রিয় পাঠক! আমাদের আর্টিকেলগুলো ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করে হাজারো মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন ৷ আপনার কোন মন্তব্য বা পরামর্শ থাকলে তাও জানাতে পারেন ৷ নিচের কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন নির্দ্বিধায় ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সাথে যুক্ত হতে ক্লিক করুন ৷ আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন ৷ জাযাকাল্লাহ খাইরান ৷

 

হাবিল কাবিলের কোরবানি | যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল
হাবিল কাবিলের কোরবানি | যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *